জীবন যে এই রকম চমক দিতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি দুই বন্ধু। প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে যে সত্যিটা সামনে এসেছে তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না ওয়াল্টার ম্যাকফারলেন ও অ্যালান রবিনসন।
ওয়াল্টারের বয়স ৭৪। অ্যালানের ৭২। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একে অপরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু তাঁরা। দু’জনেরই হনলুলুতে জন্ম। একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা। দু’জনেই একই সঙ্গে স্কুলজীবন সাঙ্গ করেন।
একই কলে়জে ভর্তি হন ওয়াল্টার ও অ্যালান। ফুটবল খেলতে ভালবাসতেন দু’জনে। দুই বন্ধু প্রায়শই রসিকতা করে বলতেন, এত মিল তাঁদের যে তাঁরা একই মেয়েকে বিয়ে করবেন। পরে অবশ্য আলাদা ভাবেই নিজেদের মতো করে পরিবার গড়ে তোলেন দু’জনে। নিজেদের মধ্যে যে বন্ধন ছিল তা পরবর্তীতে পরের প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
তাঁরা তাঁদের সন্তানদের সেই স্কুলেই পাঠান যেখানে নিজেরা পড়াশোনা করেছিলেন। দুই পরিবার প্রায়শই একসঙ্গে ছুটি কাটাতেন।
কিন্তু আসল ঘটনা জানা যায় অ্যালানের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর। বহু দিন আগে হারিয়ে যাওয়া বাবার পরিচয় সন্ধান করতে গিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করান তিনি।
তিনি নিজেও জানতেনও না এত বড় বিস্ময় অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর জন্য। এত দিন যাঁকে প্রিয় বন্ধু বলে মনে করেছেন, সেই ম্যাকফারলেন আদতে তাঁর সহোদর। সংবাদমাধ্যমকে এক সাক্ষাৎকারে অ্যালান বলেন, ম্যাকফারলেন ও তিনি একই মায়ের সন্তান তা জানার জন্য ৬০ বছর অপেক্ষা করতে হল।
হনলুলুতে ১৯৪৩ সালে জন্ম নেন ম্যাকফারলেন। চল্লিশের দশকে পার্ল হারবারে হামলার পর গোটা হনলুলু তখন বিপর্যস্ত।
ম্যাকফারলেনের মা জেনেভিভ তাঁকে দত্তক দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জেনেভিভের মা ও বাবা স্থির করেন তাঁরা নিজেদের নাতিকে ‘হানায়’ করবেন।
‘হানায়’ হল হাওয়াইয়ান সম্প্রদায়ের একটি প্রথা যেখানে একটি পরিবার কাগজপত্র-সহ বা ছাড়াই অনাড়ম্বর ভাবে যে কোনও শিশুকে দত্তক নিতে পারে। সেই প্রথামতো ওয়াল্টারকে দত্তক নিয়ে নেন জেনেভিভের মা ও বাবা।
বিশ্বযুদ্ধের অস্থির পরিস্থিতিতে ওয়াল্টারকে পরিবারের সাহচর্য দিতে নিজের মা-বাবার হাতেই তুলে দেওয়া দেন জেনেভিভ। সে ক্ষেত্রে জেনেভিভের মা হয়ে ওঠেন ওয়াল্টারের মা ও জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় হয় নিজের বোন।
অন্য দিকে ম্যাকফারলেনের জন্মের ১৫ মাসের মধ্যেই অ্যালান হনলুলুতে জন্মগ্রহণ করেন এবং জন্মের অনতিবিলম্বে তাঁকে দত্তক নেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তাঁর জন্মদাতা মা-বাবার পরিচয় কখনও জানতেই পারেননি।
তবে যে পরিবারে অ্যালান বেড়ে ওঠেন তাদের নিয়ে কোনও ক্ষোভ ছিল না বলেও জানিয়েছেন তিনি। বরং তাঁর মনে হয়েছে পৃথিবীর সেরা মানুষদের সান্নিধ্য পেয়ে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে।
হনলুলুর পুনাহাউ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় একে অপরের সঙ্গে প্রথম দেখা ম্যাকফারলেন এবং রবিনসনের। তার পর থেকেই দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের পথ চলা শুরু। এই পুনাহাউ স্কুলের একদা ছাত্র ছিলেন বারাক ওবামাও।
ওয়াল্টারের পালিতা মা বা ‘হানায়’ মায়ের সঙ্গে অ্যালানের পরিবারের বরাবর সুসম্পর্ক ছিল। রবিনসন স্মৃতিচারণ করে জানান, তাঁর পালিতা মা ছিলেন স্কুলের নার্স। তাই যখনই ওয়াল্টার অসুস্থ বা আহত হতেন তাঁর মায়ের কাছে পরামর্শ নিতে আসতেন অ্যালানের পরিবার।
কয়েক বছর আগে, রবিনসন নিজের ও পূর্বপুরুষের ডিএনএ পরীক্ষা করান। তবে সেই রিপোর্ট তিনি গোপনেই রেখে দিয়েছিলেন। আবার গত বছর কন্যাদের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ম্যাকফারলেন তাঁর জন্মদাতা পিতার পরিচয় জানার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করান। প্রায় ৮০০ জনের সঙ্গে তাঁর ডিএনএ মিলে যায়।
এর পরই আসরে নামেন ওয়াল্টারের মেয়ে সিন্ডি ম্যাকফারলেন। তিনি রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখে বার করেন ওয়াল্টারের ডিএনএ সবেচেয়ে বেশি যাঁর সঙ্গে মিলছে তিনি হলেন জনৈক ‘রবি৭৩৭’। পরীক্ষায় বলা হয়েছিল, এই ব্যক্তি তাঁর সৎভাইও হতে পারেন। প্রথমে ধারণা হয়েছিল তাঁর বাবার দিক থেকে এই সম্পর্ক হতে পারে। পরে তাঁদের দুজনের এক্স ক্রোমোজ়োমের মিল পরীক্ষা করে পাওয়া যায় তাঁরা মায়ের দিকের সহোদর ভাই।
এই তথ্য জানার পর সিন্ডি নিজের মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে রবি৭৩৭ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। প্রথমে ওয়াল্টার এই নামে কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী মার্থা জানান এ বিষয়ে পারিবারিক বন্ধু অ্যালানকে এক বার জানানো উচিত।
কারণ মার্থার মনে ছিল তিনি আলোহা এয়ারলাইন্সের হয়ে বিমান ৭৩৭টি চালিয়েছেন। অ্যালানকে বিষয়টি জানাতেই সমস্ত রহস্য খোলসা হয়। অ্যালান নিশ্চিত করেন তিনিই সেই রবি৭৩৭। প্রমাণ হয়ে যায় ওয়াল্টার ও অ্যালান সহোদর ভাই।