পুরু কার্পেটের উপর ছড়িয়ে গদিমোড়া সোফা। আশপাশে দামি কাঠের আসবাব। জানলায় মানানসই পর্দা। বাতিদানের নিভু আলোয় বসে সুরায় চুমুক দেওয়ার বন্দোবস্ত। না! এ কোনও বিলাসী হোটেল নয়। এ হল দেশের অন্যতম বিলাসী ট্রেনের অন্দরের দৃশ্য।
এ ট্রেনের পোশাকি নাম, ‘ডেকান ওডিসি’। দাক্ষিণাত্য মালভূমির নামের সঙ্গে খানিকটা সাযুজ্য রেখেই করা হয়েছে নামকরণ। রয়্যাল ব্লু রঙের এ ট্রেনে চড়লে নাকি লিমুজ়িনের আরাম পাওয়া যায়।
লক্ষ্য ছিল, মহারাষ্ট্রের পর্যটনের প্রসার ঘটানো। সেই লক্ষ্যপূরণে ২০০১ সালে ভারতীয় রেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘ডেকান ওডিসি’-র পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন মহারাষ্ট্র সরকার। রাজ্য সরকারের থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে মহারাষ্ট্র ট্যুরিজ়ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন।
পরের বছর এ ট্রেনের কামরা তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। পেরাম্বুর এবং চেন্নাইয়ে রেলের কারখানায় ২০০২-০৩ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছিল সে কামরাগুলি। তার নকশা বাছাইয়ের জন্যই লেগেছিল প্রায় পাঁচ মাস। এর পর আরও কয়েক মাস ধরে সেগুলি গড়া হয়েছিল।
‘ডেকান ওডিসি’ই অবশ্য প্রথম নয়। এ দেশে বিলাসী ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই আশির দশকে। রাজস্থান পর্যটন দফতরের ‘প্যালেস অন হুইলস’ই সে তকমা পাবে। ১৯৮৪ সালে সেটি প্রথম বার রেলপথে নেমেছিল।
২০০৪ সালে ১৬ জানুয়ারি সপ্তাহখানেকের সফরের প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল ‘ডেকান ওডিসি’। পতাকা নেড়ে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।
দেশের অন্যতম বিলাসী এ ট্রেনে মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি সফর করতে পারেন রাজস্থান, গুজরাত এবং কর্নাটকের ঐতিহ্যময় নানা পর্যটনস্থলে।
পর্যটকদের জন্য ‘ডেকান ওডিসি’র সফরতালিকায় আবার বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ৭ দিন ও ৮ রাতের ৬টি দীর্ঘ সফর। এ ছাড়া কয়েকটি সংক্ষিপ্ত সফর রয়েছে।
‘ডেকান ওডিসি’-র ৬টি সফরের প্রত্যেকটির আবার গালভরা নামও রয়েছে। যেমন, ‘মহারাষ্ট্র স্লেন্ডর’ নামের সফরের টিকিট থাকলে যেতে পারবেন মুম্বই, নাসিক, ইলোরা, অজন্তার গুহা থেকে কোলাপুর বা গোয়া। অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়ান ওডিসি’র অঙ্গ হিসাবে দেখা যেতে পারে দিল্লি, সোয়াই মাধোপুর, আগরা, জয়পুর, উদয়পুর, বরোদা থেকে শুরু করে ইলোরা গুহা বা আমের দুর্গ, তাজমহল কিংবা যন্তর মন্তরের মতো নানা জায়গা।
‘জুয়েলস অফ ডেকান’ নামে যে সফরটি রয়েছে, তাতে বিজয়পুরা, হাম্পি, হায়দরাবাদ, ইলোরা, অজন্তা গুহা অথবা মুম্বইয়ে মতো বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরাফেরা করতে পারেন। ‘মহারাষ্ট্র ওয়াইল্ড ট্রেল জার্নি’-তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ইলোরা, অজন্তা গুহা, নাসিক, মুম্বই-সহ আরও কয়েকটি পর্যটনস্থল।
‘হিডেন ট্রেজ়ার্স অফ গুজরাত’-এর সফর বাছাই করলে বরোদা, পটীয়ালা-সহ রানি কি ভাব বা চম্পানের-পাহাড়গড় প্রত্নতাত্ত্বিক পার্ক সফরের সুযোগ পাবেন। আবার ‘ইন্ডিয়ান সোজার্ন’ নামের সফরে আগ্রহী হলে দেখতে পাবেন জয়পুর, দিল্লি, আমের দুর্গ বা তাজমহল-সহ কয়েকটি জায়গা।
উৎসাহীদের জন্য রয়েছে কিরতপুর সাহিব, আনন্দপুর সাহিব, অমৃতসর, পটনা-সহ দিল্লি-মুম্বইয়ের সংক্ষিপ্ত যাত্রা।
‘ডেকান ওডিসি’ ট্রেনে বিলাসের নানা উপকরণই মজুত রয়েছে। ২,৩০০ ফুট দীর্ঘ ট্রেনে রয়েছে ২১টি কামরা। তাতে নাকি সর্বোচ্চ ৮৮ জন যাত্রী থাকতে পারেন।
ট্রেনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কামরাগুলি আবার দু’রকমের। একটি প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ও অন্যটি ডিলাক্স কেবিন।
চোখধাঁধানো অন্দরসজ্জা ছাড়াও এ ট্রেনের যাত্রীদের জন্য রাজকীয় বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এতে পা রাখতেই চোখে পড়বে বিশাল স্পা। তাতে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মেনে রয়েছে মালিশের বন্দোবস্ত।
স্পা ছাড়াও ট্রেনে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত রেস্তরাঁ, পানশালা, লাউঞ্জ, কনফারেন্স রুম, ডান্স ফ্লোর থেকে শুরু করে ১২টি কেবিন। তাতে সোফা, বিছানা থেকে ব্যক্তিগত ফোনের বন্দোবস্ত রয়েছে। এবং অবশ্যই দিবারাত্র ব্যক্তিগত পরিচারক।
ট্রেনে খাওয়াদাওয়ার এলাহি বন্দোবস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘ডেকান ওডিসি’-র ওয়েবসাইট। ‘পেশোয়া ১’ এবং ‘পেশোয়া ২’ নামে দু’টি মাল্টিকুইজ়িন রেস্তরাঁয় বসে চলতে পারে দেদার পেটপুজো। রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশন করেন চিরাচরিত মরাঠি পোশাক পরিহিত কর্মীরা।
‘ডেকান ওডিসি’তে সুরারসিকদের কথাও মনে রাখা হয়েছে। ‘মুম্বই হাই’ নামে পানশালায় রয়েছে দুনিয়ার নামী ওয়াইন-সহ সুরার সম্ভার। তবে ‘মুম্বই হাই’য়ে ঢুকে সুরাপান না করতে চাইলে অন্য পানীয়ের স্বাদ নিতে পারেন।
‘ডেকান ওডিসি’-র ওয়েবসাইট অনুয়ায়ী, ৭ রাত ও ৮ দিনের দীর্ঘ সফরে একটি ডাবল বেডের ডিলাক্স কেবিনের জন্য টিকিটের দাম ১১,৯০০ ডলার। সিঙ্গল বেড হলে ৮,৩৩০ ডলার দিতে হবে। অন্য দিকে, প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের এ ধরনের কেবিন পেতে হলে সিঙ্গল হোক বা ডাবল বেড, খসাতে হবে ১৭,৮৫০ ডলার। ঘাবড়ে যাবেন না। এই দাম শুধুমাত্র বিদেশ পর্যটকদের জন্য। বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটের দাবি, দেশীয় নাগরিকদের জন্য টিকিটের দাম (ডিলাক্স) খানিকটা কম। প্রতিটি কেবিনের শিশুদের জন্য টিকিটের দাম অবশ্য কিছুটা কম।