বেতন বাবদ যত টাকা পাওয়ার কথা, মাসের শেষে মিলছে তার চেয়ে কিছুটা কম অর্থ। বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের মধ্যে এই নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের হাতে কি ‘ইচ্ছাকৃত ভাবে’ কম বেতন দিয়ে থাকে নিয়োগকারী সংস্থা? না কি এর নেপথ্যে রয়েছে কোনও নিয়মের বেড়াজাল? চাকরিরতদের তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতনের দু’টি অংশ থাকে। একটি হল, সিটিসি বা ‘কস্ট টু কোম্পানি’। অপর অংশটির নাম ‘ইন হ্যান্ড স্যালারি’। অর্থাৎ, হাতে পাওয়া বেতনের অংশ। এই দু’টির পার্থক্য বুঝতে পারলেই প্রতি মাসে বেতন বাবদ কত টাকা মিলবে, তার হিসাব বুঝতে পারবেন সংশ্লিষ্ট কর্মী।
এখন প্রশ্ন হল, সিটিসি আসলে কী? কোনও কর্মীর পিছনে তাঁর নিয়োগকারী সংস্থা বছরে যে টাকা ব্যয় করে, অর্থনীতির পরিভাষায় তাকেই বলা হয় কস্ট টু কোম্পানি। চাকরি দেওয়ার সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে এই আর্থিক প্যাকেজের কথাই বলে থাকে নিয়োগকারী সংস্থা। নিয়ম অনুযায়ী, কখনওই সিটিসির পুরো অর্থ কোনও কর্মী বেতন বাবদ পেতে পারেন না। ‘ইন হ্যান্ড স্যালারি’ ও সিটিসির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
সিটিসি থেকে বেশ কিছু টাকা কেটে নিয়ে ‘ইন হ্যান্ড স্যালারি’ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সিটিসির মধ্যে থাকে একাধিক উপাদান। সেগুলি হল মূল বেতন (বেসিক পে), বাড়ি ভাড়ার ভাতা (হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স বা এইচআরএ), চিকিৎসা বিমা এবং ভবিষ্যৎ তহবিল। এ ছাড়াও খাবার ভাউচার, ট্যাক্সি বা গাড়ির বিল, ভর্তুকি যুক্ত ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
সিটিসি থেকে প্রথমেই কেটে নেওয়া হয় এমপ্লোয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ইপিএফের টাকা। বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই তহবিল তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। এখানে টাকা জমা রাখা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। আর তাই সেটি বাদ দিয়ে ‘ইন হ্যান্ড স্যালারি’র হিসাব করে নিয়োগকারী সংস্থা।
ইপিএফের পাশাপাশি সিটিসি থেকে বাদ যায় গ্র্যাচুইটির টাকা। এর পর বেতনের যে অঙ্কটি দাঁড়ায় তার থেকে বাদ যায় আয়কর এবং পেশাদার কর বা প্রফেশনাল ট্যাক্স। আবার ‘ইন হ্যান্ড স্যালারি’তে যোগ হয় বোনাস, অতিরিক্ত সময় কাজ করার অর্থ (ওভারটাইম পে) এবং সবেতন ছুটির টাকা।
গ্র্যাচুইটি হল বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতনেরই একটা অংশ। একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর কৃতজ্ঞতা হিসাবে ওই টাকা দিয়ে থাকে নিয়োগকারী সংস্থা। প্রাথমিক ভাবে অবসরের পর গ্র্যাচুইটির টাকা পেয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট কর্মী। আয়কর আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম পাঁচ বছর চাকরি করলে, তিনি গ্র্যাচুইটি পাওয়ার যোগ্য হয়ে থাকেন।
‘ইন হ্যান্ড বেতন’-এরই অপর নাম ‘টেক হোম পে’। কর, প্রভিডেন্ট ফান্ড-সহ যাবতীয় কাটছাঁটের পর এক জন কর্মী যে টাকা হাতে পান বা বলা ভাল বেতন বাবদ বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, তাঁরই পোশাকি নাম ‘টেক হোম পে’। এ ছাড়া বেতনের ক্ষেত্রে আরও দু’টি শব্দ ব্যবহার করা হয়। সেগুলি হল ‘গ্রস পে’ ও ‘নেট পে’।
সিটিসি থেকে আয়কর, পেশাগত কর এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক কাটছাঁটের পর টাকার পরিমাণ যত দাঁড়াবে, তাঁকে বলে ‘গ্রস পে’। সিটিসির মধ্যে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ), ছুটি ও ভ্রমণ ভাতা (লিভ ট্র্যাভেল অ্যালাউন্স বা এলটিসি), জ্বালানি ভাতা (ফুয়েল অ্যালাউন্স), ফোনের বিল, ইনসেনটিভ এবং বিশেষ ভাতা বা স্পেশ্যাল অ্যালাউন্স সংযুক্ত থাকতে পারে।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া যাক। ধরা যাক, এক জন ব্যক্তির সিটিসি ছ’লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, ওই কর্মীর জন্য বছরে ছ’লক্ষ টাকা খরচ করবে তাঁর নিয়োগকারী সংস্থা। এখন যদি তিনি ৪০ হাজার টাকা বোনাস পান, তা হলে ওই ব্যক্তির গ্রস বেতন দাঁড়াবে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে সিটিসি থেকে বোনাসের টাকা বাদ দিয়ে ‘গ্রস পে’ হিসাব করা হবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রস বেতন থেকে বাদ যাবে পেশাদার কর এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড তহবিলে জমা করা টাকা। ধরা যাক তার পরিমাণ বছরে যথাক্রমে ২,৪০০ টাকা ও ২০ হাজার ৫০০ টাকা। ইপিএফের নিয়ম হল, কর্মীর বেতনের যে পরিমাণ টাকা ওই তহবিলে জমা পড়বে, সম পরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও জমা করতে হবে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ৪১ হাজার টাকা বাদ পড়বে। পেশাদার কর মিলিয়ে মোট কাটছাঁটের অঙ্ক দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ৪০০ টাকা।
গ্রস বেতন থেকে এই তিনটি টাকার অঙ্ক বাদ দিলে যে অর্থ পড়ে থাকবে, তা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন সংশ্লিষ্ট কর্মী। এ ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির ‘টেক হোম স্যালারি’র পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লক্ষ ১৬ হাজার ৬০০ টাকা। গ্রেস পে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা থেকে ৪৩ হাজার ৪০০ টাকা বাদ দিয়ে এই হিসাব করা হয়েছে।
এর পর প্রতি মাসের বেতন জানতে হলে এই টাকার অঙ্ককে ১২ দিয়ে ভাগ করতে হবে। তখন টাকার পরিমাণ কমে দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ৫০। এই অর্থই প্রতি মাসে বেতন বাবদ সংশ্লিষ্ট কর্মী হাতে পাবেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হল, সিটিসি থেকে প্রতি মাসের বেতন জানতে প্রথমেই ‘গ্রস পে’ হিসাব করতে হবে। এর পর পেশাগত কর এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা বাদ দিলে প্রতি মাসে হাত কত টাকা মিলবে, তা বুঝতে পারবেন সংশ্লিষ্ট কর্মী।
চাকরি পাওয়ার সময়ে সংস্থার তরফে সিটিসির কথাই বলা হয়। ওই সময়ে টেক হোমের পরিমাণ ভাল করে বুঝে নেওয়া উচিত। নইলে মাসের পর মাস কাজ করে সংস্থার তরফে বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ থাকতে পারে। এ ব্যাপারে কথা বলে তবেই কাজে যোগ দিতে বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
বর্তমানে আয়করের ক্ষেত্রে দু’টি কর কাঠামো চালু রয়েছে। এর মধ্যে নতুন কাঠামোয় আয়করের সরলীকরণ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এতে আলাদা আলাদা করে কর ছাড়ের পরিমাণ কমিয়েছে সরকার। ফলে টেক হোমের পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মধ্যবিত্তর স্বস্তির কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত বলে স্পষ্ট করেছে কেন্দ্র।
চলতি বছরের ২৩ জুলাই সপ্তম বারের জন্য সংসদে বাজেট পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সেখানে আয়করের নতুন কর কাঠামোয় স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন তিনি। এত দিন এটি ছিল ৫০ হাজার টাকা। নতুন কর কাঠামোয় এ বার থেকে তা বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করেছেন তিনি।
নতুন কর কাঠামোয় আয়করের মোট ছ’টি স্ল্যাব রয়েছে। এর মধ্যে ০ থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে করের পরিমাণ শূন্য রাখা হয়েছে। তিন থেকে সাত লক্ষ টাকা বার্ষিক আয় হলে পাঁচ শতাংশ কর ধার্য হবে। ১০ শতাংশ কর দিতে হবে বার্ষিক সাত থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয় করা নাগরিকদের।
এ ছাড়া নতুন কাঠামোয় আরও তিনটি আয়করের স্ল্যাব রয়েছে। সেগুলি হল, ১৫, ২০ এবং ৩০ শতাংশ। বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লক্ষ, ১২ থেকে ১৫ লক্ষ এবং ১৫ লক্ষ টাকার বেশি হলে তবেই ওই কর দিতে হবে। কর ব্যবস্থাকে আরও সরল করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।