একটি সময়ে চিজ়, চকোলেট আর ঘড়ির দেশের থেকে মিলেছিল ‘সবচেয়ে পছন্দের রাষ্ট্র’ বা ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন’-এর (এমএফএন) তকমা। কিন্তু হঠাৎ করেই নয়াদিল্লির মাথা থেকে সেই মুকুট কেড়ে নিল তারা। ‘পৃথিবীর স্বর্গ’ হিসাবে খ্যাত সুইৎজ়ারল্যান্ডের এ-হেন পদক্ষেপে রীতিমতো হতবাক আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সুইৎজ়ারল্যান্ডের এই সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে ভারতের শেয়ার বাজারে। আগামী দিনে কমতে পারে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। অন্য দিকে, আর্থিক দিক থেকে লোকসান হবে ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর দেশটিরও। যদিও সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে সুইস সরকার।
আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১ জানুয়ারি থেকে এমএফএন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে বের্ন। ওই তারিখ থেকে সুইৎজ়ারল্যান্ডে ব্যবসা করা ভারতীয় সংস্থাগুলিকে তাদের আয়ের উপর ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশের ক্ষেত্রে বেশি কর দিতে হবে। এর পরিমাণ ১০ শতাংশ বলে জানা গিয়েছে।
এ ছাড়া সুইস নাগরিকদের ভারতে ব্যবসা বা শেয়ারের লগ্নি থেকে আয়ের উপর বেশি হারে কর দিতে হবে। এর ফলে এ দেশের বাজারে তাঁদের বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ্যযোগ্য ভাবে কমতে পারে বলে মনে করেছন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বের্ন থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি লগ্নি এসেছে ভারতের মাটিতে।
এ দেশে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির উপর সুইস প্রশাসনের রাগের মূল কারণ লুকিয়ে আছে ‘দ্বৈত কর সংক্রান্ত চুক্তি’ বা ‘ডাবল ট্যাক্স অ্যাভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট’-এ (ডিএটিটি)। বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের ১১ ডিসেম্বর বিবৃতি দিয়েছে বের্নের অর্থ মন্ত্রক। সেখানেই উঠে এসেছে গত বছর (পড়ুন ২০২৩) নেস্লে মামলায় দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়।
এখন প্রশ্ন হল, ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’ বলতে কী বোঝায়? মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তিতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে কোনও একটি দেশকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে অপর রাষ্ট্র। এই তকমা পেলে শুল্ক ও করের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ছাড় পাওয়ার সুযোগ থাকে।
ভারত ও সুইৎজ়ারল্যান্ডের মধ্যে ‘দ্বৈত কর সংক্রান্ত চুক্তি’ রয়েছে। এই অবস্থায় নয়াদিল্লিতে এমএফএনের তকমা দিয়েছিল বের্ন। এই দু’য়ের জোরে ভারতে বাণিজ্যরত সুইস সংস্থাগুলিকে যাতে কম কর দিতে হয়, সেই সুবিধা চেয়েছিল ইউরোপের চিজ়-চকোলেটের দেশ।
বিদেশে বিনিয়োগ বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লগ্নিকারীকে নিয়মমাফিক দু’টি দেশে কর দিতে হয়। এতে অনেকটাই কমে যায় লাভের অঙ্ক। সেই সমস্যা মেটাতে ‘দ্বৈত কর সংক্রান্ত চুক্তি’ করে বাণিজ্যরত দু’টি রাষ্ট্র। এই চুক্তির জোরে কর ছাড় পান বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফলে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।
সুইৎজ়ারল্যান্ডের অভিযোগ, ‘অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বা ওইসিডিভুক্ত দেশগুলিকে বেশি পরিমাণ কর ছাড় দিচ্ছে ভারত। অন্য দিকে, চুক্তি থাকা সত্ত্বেও নেস্লের মতো সুইস সংস্থাকে বেশি কর দিতে হচ্ছে। ফলে আশানুরূপ লাভ হচ্ছে না। এই কারণ দেখিয়েই দিল্লিকে দেওয়া ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর তকমা কেড়ে নিয়েছে বের্ন।
কয়েক বছর আগে ইউরোপের লিথুয়ানিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়ার সঙ্গে বিশেষ বাণিজ্যচুক্তি করে ভারত। সেই চুক্তি অনুযায়ী, এই দুই দেশের সংস্থাগুলির লভ্যাংশের উপর মাত্র পাঁচ শতাংশ আয়কর ধার্য করেছে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে সুইস সংস্থা নেস্লের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ১০ শতাংশ হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে।
লিথুয়ানিয়া এবং কলম্বিয়া পরবর্তী সময়ে ওইসিডিতে যোগ দেয়। এই সংগঠনটির সদর দফতর রয়েছে ফ্রান্সের প্যারিসে। সংশ্লিষ্ট দেশ দু’টি ওইসিডিতে গেলেও সেখানকার সংস্থাগুলির লভ্যাংশের উপর করের ক্ষেত্রে কোনও বদল করেনি নয়াদিল্লি।
২০২১ সালে ভারতের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে সুইস প্রশাসন। এর পরই সেখানকার সংস্থা নেস্লে তাঁদের লভ্যাংশের উপর মাত্র পাঁচ শতাংশ কর দিতে চেয়েছিল। কিন্তু নয়াদিল্লির যুক্তি ছিল লিথুয়ানিয়া এবং কলম্বিয়ার সঙ্গে আগে ভাগে চুক্তি সারা হয়েছে। ওইসিডি ভুক্ত অন্য দেশগুলিকে এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। আর এই চুক্তির সঙ্গে সুইস সংস্থা নেস্লের আয়করের কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু নেস্লে বিষয়টি মানতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য দিল্লি হাই কোর্টে মামলা ওঠে। পরে তা চলে যায় সুপ্রিম কোর্টে। গত বছর (পড়ুন ২০২৩) এই ইস্যুতে দেওয়া রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, দ্বৈত চুক্তির অধীনে আপনা থেকেই পছন্দসই কর ঠিক করা যাবে এমনটা নয়। এ জন্য আয়কর আইন অনুসারে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। এই রায়ের জেরে আপাতত নেস্লেকে ১০ শতাংশ করই দিতে হবে।
চলতি বছরের মার্চে সুইৎজ়ারল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিখটেনস্টাইনের সঙ্গে বিশেষ বাণিজ্য চুক্তি করে কেন্দ্র। সুইস প্রশাসন ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ তকমা কেড়ে নেওয়ায় দুই দেশের দ্বৈত কর চুক্তি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণবীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘‘সুইস সরকারের পদক্ষেপে আমরা হতাশ। নতুন করে দ্বৈত চুক্তির অনেক কিছু আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।’’ তবে এ ব্যাপারে সরকার যে অতি সাবধানে পা ফেলতে চাইছে, তা একরকম স্পষ্ট করেছেন তিনি।
সুইৎজ়ারল্যান্ডে লম্বা সময় ধরে ব্যবসা করে আসছে তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মা ও আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা। সুইস সরকারের সিদ্ধান্তে তাঁদের লাভের অঙ্ক অনেকটাই কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক উপদেষ্টা সংস্থা জিটিআরআই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, সুইস সংস্থাগুলি ভারতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পাল্টালে কয়েক হাজার কোটি ডলার লগ্নি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অবশ্য দাবি, পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি হাতের বাইরে যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে নতুন কৌশল নিতে হবে। সুইস সংস্থাগুলির উপর পাল্টা চাপ তৈরি করতে শুল্ক নীতিতে বদল আনার রাস্তা খোলা রয়েছে নয়াদিল্লির কাছে।
তবে এর সবচেয়ে বড় প্রভাব শেয়ার বাজারের উপর পড়তে পারে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে বাজার। কিন্তু সুইস সরকারের পদক্ষেপে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফেরাতে পারেন। এতে স্টক সূচকের নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।