ইউরোপের রেনেসাঁর চারণভূমিতেই মহাসঙ্কট। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। অন্য দিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনশূন্য হয়ে পড়ছে ভূমধ্যসাগরের কোলের এককালের বিরাট সাম্রাজ্য বিস্তারকারী রাষ্ট্র। সব দেখেশুনে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরাও।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘মস্তিষ্ক নির্গমন’-এর (পড়ুন ব্রেন ড্রেন) সমস্যায় ভুগছে ইটালি। রোম, ভেনিস, মিলান ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন সেখানকার মেধাবী ছেলেমেয়েরা। মূলত আর্থিক কারণই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশত্যাগ করা ইটালীয়দের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাঁদের এক তৃতীয়াংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। শুধু তাই নয়, ২৭-২৮ বছর বয়সি ইটালীয় তরণ-তরুণীরা মনে করেন, দেশত্যাগ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই।
এই ইস্যুতে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপি। সেখানে দক্ষিণ ইটালির ক্যালাব্রিয়া থেকে রোমে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা ২৪ বছরের তরুণ বিলি ফুস্টোর কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘এখানে শান্ত জীবন পাওয়া বড়ই দুর্লভ হয়ে পড়ছে। সামান্য কিছু কেনাকাটার জন্য পকেটে ১৫ ইউরো রয়েছে কি না, সেটা নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে।’’
এ বছরের অক্টোবরে ‘ব্রেন ড্রেন’ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করে ইটালির ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড লেবার’ (সিএনইএল)। সেখানে উঠে আসে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট রেনাটো ব্রুনেটার কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতি একেবারেই স্বাভাবিক নয়। ব্রেন ড্রেনের রক্তক্ষরণ কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সরকার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুক, কেন এমনটা হচ্ছে। নইলে এর প্রতিকার সম্ভব নয়।’’
দক্ষিণ ইটালির দারিদ্র চোখে পড়ার মতো। সেখানকার অনেকেই ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দেন দেশের উত্তর অংশে। গত দু’দশকে দক্ষিণের স্নাতক উত্তীর্ণদের নিজের এলাকা ছেড়ে উত্তরে চলে যাওয়ার প্রবণতা ১৮ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
তবে আর্থিক দিক থেকে উত্তর ইটালির অবস্থা যে দুর্দান্ত, এমনটাও নয়। সেখানে শিল্প শহরের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উত্তর ইটালিতে মজুরি বেশ কম। ফলে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছেন প্রতিভাবান ইটালীয় তরুণ-তরুণীরা।
৩৮টি দেশের সংগঠন ‘অর্গানাইজ়েশন অফ ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ বা ওইসিডির অন্যতম সদস্য হল ইটালি। ২০১৯ তুলনায় সেখানে প্রকৃত মজুরি কমেছে। ওইসিডিভুক্ত অন্য কোনও রাষ্ট্রে এই প্রবণতা দেখা যায়নি।
ইউরোপের গড় বেকারত্বের নিরিখে একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে ইটালির নাম। এ বছরের অক্টোবরে ভূমধ্যসাগরের কোলের দেশটির বেকারত্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭.৭ শতাংশ। এই সংখ্যা ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৫.২ শতাংশ।
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, দিন দিন ইটালির কর্মক্ষেত্র মেধাহীন হয়ে পড়ছে। জর্জিয়া মেলোনির সরকার কোনও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঠিক করেননি। উচ্চশিক্ষার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেখানে প্রতি বছর বেতনবৃদ্ধির ব্যবস্থাও নেই।
এই ইস্যুতে এএফপির কাছে মুখ খুলেছেন ২৭ বছরের ইটালীয় তরুণী এলেনা পিকার্ডি। ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর রোমে ফিরে আসেন পিকার্ডি। তিনি বলেছেন, ‘‘এখানকার সংস্থাগুলির থেকে পাওয়া প্রস্তাবের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও মজুরির কথা লেখা থাকে না। অথবা খুব কম মজুরিতে লোক নিয়োগ করতে চায় তারা।’’
বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির মজুরি ভাল। সেখানে প্রতি মাসে কয়েকশো ডলার রোজগারের সুযোগ রয়েছে। এলেনা পিকার্ডির কথায়, ‘‘আমাদের মতো তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন রয়েছে। কিন্তু সেটা আমার যাবতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সম্ভাবনাকে শেষ করে নয়। ইউরোপের অন্য দেশে গেলে সম্মান ও অর্থ দু’দিক থেকে লাভের সুযোগ থাকবে।’’
নর্থ ইস্ট ফাউন্ডেশনের সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, ‘ব্রেন ড্রেন’-এর জেরে গত ১২ বছরে বিপুল টাকা হারিয়েছে ইটালি। ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এর জন্য আনুমানিক ১৩ হাজার ৪০০ কোটি ইউরোর মূল্য দিয়েছে প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতার দেশ।
দেশত্যাগীদের মধ্যে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছে সমীক্ষকদের দল। এই ইটালীয়দের যুক্তি, পরিবারের টানেই ‘ঘরওয়াপসি্’ হয়েছে তাঁদের। কারও কারও ক্ষেত্রে আবার প্রয়োজনের খাতিরেও বাড়িতে থাকার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে।
সমীক্ষক সংস্থা ‘ইউরোস্ট্যাট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশত্যাগী ইটালীয়দের গড় বয়স ছিল ৩০, স্পেন ও গ্রিসের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ানের মধ্যে যা ছিল সর্বাধিক। তবে দীর্ঘ দিন ধরেই বয়স্কদের তুলনায় তরুণ-তরুণীরা বেশি করে ইটালি ছাড়ছেন।
বর্তমানে ইটালিতে কর্মরত এবং বেকার নাগরিকদের অনুপাত ৩:২। কিন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে এই অনুপাত ১:১ গিয়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই (পড়ুন ৫০ শতাংশ) বেকারত্বের জ্বালায় ভুগবেন।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে প্রবাসী ইটালীয়দের দেশে ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মেলোনি। তাঁদের জন্য আয়করে বিরাট অঙ্কের ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। সন্তানকে নিয়ে দেশে ফিরলে প্রবাসীদের আরও কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেবে রোম।
এর পাশাপাশি, গত কয়েক বছর ধরে আরও একটি সমস্যায় ভুগছে ইটালি। সেটি হল জন্মহার অস্বাভাবিক কমে যাওয়া। ফলে ধীরে ধীরে বয়স্ক নাগরিকদের দেশে পরিণত হচ্ছে ইটালি। আর তাই আর্থিক লোভ দেখিয়ে নাগরিকদের সন্তান উৎপাদনের জন্য উৎসাহিত করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মেলোনি।