ছাড় পান না স্বয়ং দেবতাও। অন্যায় করলে ভক্তদের মতোই ‘শাস্তি’ ভোগ করতে হয় ভগবানকেও। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকেও নশ্বর মানুষের শাস্তির কোপে পড়তে হয়। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও ভারতে রয়েছে এমনই একটি অঞ্চল যেখানে দেবতাকে আদালতে ‘আসতে’ হয়। বিচারের শেষে থাকে শাস্তির নিদানও।
ছত্তীসগঢ়ের বস্তারে এমনই অদ্ভুত প্রথা চলে আসছে বছরের পর বছর। সেখানে রীতিমতো আদালত বসিয়ে ঈশ্বরের বিচার চলে।
ছত্তীসগঢ়ের বস্তার। সেখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই উপজাতি। এঁদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি পৌরাণিক এবং লোককাহিনি নির্ভর। গোন্দ, মারিয়া, ভাতরা, হালবা এবং ধুরওয়া উপজাতিরা শতাব্দীপ্রাচীন নানা ঐতিহ্যের চর্চা করেন, যা এই অঞ্চলের বাইরে শোনা যায় না। এই লোকচর্চা ও ধর্মীয় চর্চা বস্তারের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করা হয়।
বিভিন্ন প্রথার মধ্যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই ‘ঈশ্বরের শাস্তি’। এই জন্য প্রতি বছর বর্ষাকালে স্থানীয় ভাঙারামদেবী মন্দির চত্বরে বসে জনতার আদালত। ওই সময়ে তিন দিন ধরে হয় ‘ভাদো যাত্রা।’ সেখানেই চলে দেবতার বিচার।
তিন দিনের এই বিচার পর্বে অভিযুক্ত দেবদেবীর বিচারকের ভূমিকায় দেখা যায় ভাঙারামদেবীকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস, বহু শতাব্দী আগে বর্তমান তেলঙ্গানার ওয়ারাঙ্গল থেকে ভাঙারামদেবী বস্তারে এসেছিলেন।
ভাঙারামদেবীর নেতৃত্বে শুরু হয় বিচারসভা। সেখানে বিচার হয় মন্দিরের ভিতরে থাকা দেবদেবীদের।
জনজাতি গোষ্ঠীগুলির নেতৃত্ব সেখানে আইনজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বিচার পর্বে বিভিন্ন পশুপাখি, বিশেষত মুরগিকে সাক্ষী হিসাবে হাজির করানো হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে গেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিচারকের সামনে স্থানীয় বাসিন্দারা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে হাজির হন। তাঁদের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবীরা।
ঠিক মতো ফলন না হওয়া কোনও রোগের প্রাদুর্ভাব রুখতে না পারা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে না পারা কিংবা ভক্তদের মানতে সাড়া না দেওয়া, এই সব নিয়ে বিচার পর্ব চলে ভাঙারামদেবীর সভাপতিত্বে।
জন আদালত বিচারের পর শাস্তির পালা। দেবতার অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে শাস্তির পরিমাণ ধার্য করেন গ্রামবাসীরাই।
কী সেই শাস্তি? কিছু দিনের জন্য কারাবাস, মন্দির থেকে নির্বাসন বা চির নির্বাসনের মতো কঠিন শাস্তি ভোগ করেন দেবতারা।
কারাদণ্ডের শাস্তিস্বরূপ একটি বড় গাছের তলায় বসিয়ে রাখা হয় কাঠের তৈরি মূর্তিরূপী দেবতাদের। যাঁরা ‘টোটেম’ নামেই অধিক পরিচিত। আর যাঁদের নির্বাসনে পাঠানো হয়, তাঁদের মন্দিরের পিছনে একটি জায়গায় রেখে আসা হয়।
তবে নির্বাসিত দেবতাদের সমস্ত পোশাক পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার-সহ রেখে আসা হয় মন্দিরের পিছনের ফাঁকা চত্বরে। স্থানীয়দের দাবি, শাস্তিপ্রাপ্ত কোনও দেবদেবীর মূর্তি থেকে একটিও গয়না কখনও চুরি হয়নি।
জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন, দেবতার গয়না কেউ চুরি করলে তাঁর উপরও দেবদেবীর শাস্তির খাঁড়া নেমে আসবে।
এই বিচার পর্ব দেখতে প্রায় ২৪০টি গ্রামের বাসিন্দারা হাজির হন মন্দির চত্বরে। রান্নাবান্না করে পেটপুজোর মাধ্যমে শেষ হয় অভিনব বিচার পর্ব।
যে কোনও সরকারি আদালতের মতো ঈশ্বরের বিচারসভারও একটি খাতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এতে প্রতিটি মামলার বিবরণ তালিকাভুক্ত করে রাখেন গ্রামবাসীরা।
অভিযুক্ত দেবতার সংখ্যা, তাঁদের অভিযুক্ত অপরাধের প্রকৃতি, সাক্ষী এবং চূড়ান্ত রায়— সবেরই খতিয়ান থাকে সেই খাতায়।
নির্বাসিত দেবতারা ‘ক্ষমা’ চাইলে এবং ভাঙারামদেবীকে ‘রাজি’ করাতে পারলে তাঁদের নির্বাসন স্থগিত করা হয়। যদি তাঁরা তাঁদের আচরণ সংশোধন করতে পারেন তবেই মন্দিরে ফিরতে পারেন।
স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও লোককথা বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এটি একটি সামাজিক ব্যবস্থা। জনজাতির বিশ্বাস এই যে, সমাজে দেবতাদের দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষ যেমন দায়ী, তেমন দেবতাদেরও দায়িত্ব বহন করতে হবে।
যদি তাঁরা মানুষকে রক্ষা করতে বা সাহায্য করতে ব্যর্থ হন তবে তাঁরাও শাস্তির সম্মুখীন হবেন। ঈশ্বর যেমন মানুষের কর্মফল বিচার করেন, তেমনই ঈশ্বরের বিচারও মানুষ করতে পারেন। তিনিও বিচারের ঊর্ধ্বে নন।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও যে মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, এমনই বার্তা দেওয়া হয় এই প্রথার মাধ্যমে।