আলি মানিকফন। ওরফে মুরাইদুগানদুয়ার আলি মানিকফন। লক্ষদ্বীপের এই বাসিন্দা ২০২১ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
পড়াশোনা করেছেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। পুঁথিগত পড়াশোনার উপর বিশ্বাস ছিল না মানিকফনের। তিনি মানতেন, পরিবেশের কাছাকাছি থাকলেই অনেক কিছু শেখা যায়।
মানিকফনের বাবা পড়াশোনার সূত্রে তাঁকে কুন্নুরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। মানিকফনের দাদু ছিলেন পেশায় মৎস্যজীবী। দাদুর সঙ্গেই মাছ ধরতে যেতেন তিনি।
মানিকফন এক সাক্ষাৎকারে জানান, দাদুর হাত ধরেই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ভিন্ন রকমের মাছ, জাহাজ, সামুদ্রিক প্রাণী, তারা দেখে দিক নির্ধারণ করা শিখেছেন তিনি।
সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের ভাষার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালম, আরবি, ফরাসি, লাতিন, রাশিয়ান, জার্মান, সিংহলি, পার্সি, সংস্কৃত, তামিল ও উর্দু ভাষায় দক্ষ তিনি।
আবহাওয়া দফতরের অনুরোধে তিনি লাইটহাউসে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতেন। কখনও শিক্ষকের পেশায়, কখনও কেরানির পদেও কাজ করেছেন মানিকফন।
হাইড্রোজেন বেলুন উড়িয়ে আবহাওয়া কেমন থাকবে তা-ও নির্ধারণ করতে পারতেন তিনি। সমুদ্র মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের রসায়ানাগারে সমুদ্র জীববিজ্ঞানী সান্থাপ্পন জোনসের অধীনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
মানিকফনের প্রতিভা দেখে জোনস অভিভূত হন। জোনস তাঁর ছাত্রের জীবনে এক নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ঘটনা। লক্ষদ্বীপের মানিকফনের সঙ্গে জোনস পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টিম সেভেরিন নামের এক আইরিশ পর্যটকের।
মানিকফনের গুণ সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। জাহাজ তৈরির কাজেও যে তিনি পটু ছিলেন তা জানতেন টিম। দু’জন মিলে একটি জাহাজ বানানোর পরিকল্পনা করেন।
কেরলের নৌকাগুলি যে ধরনের কাঠ দিয়ে তৈরি হয়, সেই কাঠ দিয়েই তাঁরা তৈরি করলেন ৮০ ফুট লম্বা, ২২ ফুট চওড়া একটি জাহাজ। ওমানে ৩০ জনের সহায়তায় এক বছরের মধ্যে টিম ও মানিকফন জাহাজ বানানোর কাজ শেষ করেন।
এই জাহাজের নাম দেওয়া হয় ‘সোহার’। টিম এই জাহাজ নিয়ে ওমান থেকে ৯,৬০০ কিমি যাত্রা করে চিন পৌঁছন। ‘সোহার’ তৈরি করতে কোনও রকম ধাতুর ব্যবহার করেননি মানিকফন। বর্তমানে জাহাজটি ওমানের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ম্যারিটাইম হিস্ট্রিতে রাখা রয়েছে।
এখন তিনি কেরলের কোজিকোড় জেলার ওলাভান্না শহরে খুব সাধারণ ভাবে জীবন কাটান। খাবার রান্না করা থেকে শুরু করে মাছ ধরা সবকিছুই একা হাতে সামলান মানিকফন।
সৌরশক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করে নিজের বাড়িতে সেই সংযোগ স্থাপন করেছেন মানিকফন। ব্যাটারিচালিত সাইকেলও তৈরি করেছেন তিনি।
১৫ একরের অনুর্বর জমিতে চাষ করে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত করেছেন। গত ছয় দশক ধরে তিনি বিশ্বের নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন। এই বিশ্বকেই তিনি শিক্ষালাভের জন্য আদর্শ মনে করেন।
তাঁর চার সন্তানও রয়েছে। প্রত্যেককেই তিনি নিজের আদর্শে বড় করে তুলেছেন। মানিকফনের তিন মেয়ে শিক্ষকতার পেশায় এবং তাঁর এক মাত্র ছেলে নৌবাহিনীতে কর্মরত। তাঁর ছেলেমেয়েরাও মানিকফনের মতো পূঁথিগত বিদ্যায় বিশ্বাসী নন।