বিশ্ব জুড়ে যেন অর্থনৈতিক মন্দার ধুম লেগেছে। দেশে দেশে নুইয়ে পড়ছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মানদণ্ড। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ মন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হালে মন্দার কথা জানিয়েছে নিউ জ়িল্যান্ডও।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানি। এখন তারাও মন্দার পথে। ইউরোপের আরও ১৯টি দেশে অর্থনীতির সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা কারও অজানা নয়। দেশটির অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল কিছু দিন আগেই। যা থেকে রাজনৈতিক সঙ্কটও জন্ম নেয়। আগুন জ্বলে ওঠে শ্রীলঙ্কা জুড়ে।
ভারতের আর এক পড়শি পাকিস্তানের অর্থনীতিও নড়বড়ে। আইএমএফ ঋণ দেওয়ার বন্ধ করার পর দেশটি কার্যত দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। অবস্থা এতই করুণ যে, এ বছর হজের কোটা তুলে নিয়েছে ইসলামাবাদ।
আমেরিকায় ব্যাঙ্ক সঙ্কটও কম বিপজ্জনক নয়। ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাঙ্ক, সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্ক পর পর দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। যা অর্থনীতির দুনিয়ায় তৈরি করেছে নতুন সঙ্কট। অর্থনীতির এই টানাপড়েনে বাদ পড়েনি চিনও।
সম্প্রতি চিন এমন একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে প্রবেশ করছে, যাকে বলে ‘ব্যালেন্স শিট রিসেশন’। এতে বিনিয়োগ করে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির চেয়ে মানুষ ঋণের অঙ্ক হ্রাসের দিকে বেশি নজর দেয়। এর ফলে সামগ্রিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি।
তাইওয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ রিচার্ড কু ‘ব্যালেন্স শিট রিসেশন’ কথাটির প্রচলন করেন। তিনি জাপানের নোমুরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ।
‘ব্যালেন্স শিট রিসেশন’ শব্দবন্ধ এমন এক অবস্থাকে চিহ্নিত করে, যখন পারিবারিক এবং ব্যবসায়িক সম্পদের মূল্য কমে যায়। এতে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। মানুষ আরও বেশি করে অর্থ সঞ্চয়ের দিকে ঝোঁকে। কমে যায় বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যেই চিনে তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশের বেশ কিছু বড় ব্যাঙ্ক তাদের টাকা জমা দেওয়া বা আমানতের হার কমিয়ে দিয়েছে। চিনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক শর্ট টার্ম পলিসি রেট ১০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ১.৯ শতাংশ করেছে।
চিনে উৎপাদন বৃদ্ধির আশায় বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার ট্যাক্স ইনসেন্টিভ বৃদ্ধি করা হয়েছে। নীতি নির্ধারণকারীদের আশা, এতে শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনে লক্ষ্মীলাভ হবে।
চিনের অর্থনীতিবিদেরা এই টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একাধিক পরামর্শ দিয়েছেন। বলা হয়েছে, যাঁরা সাধারণত সামাজিক তহবিলে অর্থ বিনিয়োগ করেন, তাঁরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারেন। এতে গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
চিনের অন্যতম বড় সমস্যা জন্মহার কমে যাওয়া। সেখানে মানুষ বিয়ে করে সংসার পাততে আগ্রহী নন। সন্তানের জন্মও দিতে চান না অনেকেই। এই সমস্যার সমাধানে চিনা অর্থনীতিবিদ রেন জ়েপিং একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তাঁর পরামর্শ ছিল, সরকারের উচিত অর্থনীতিতে গতি আনতে অবিলম্বে অন্তত ২৩ লক্ষ কোটি টাকা জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। হাতে টাকা পেলে সন্তান পালনের ইচ্ছা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে। কিন্তু সরকার তাঁর পরামর্শে কান দেয়নি। উল্টে ওই অর্থনীতিবিদকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল গত বছর।
অনেকে বলছেন, চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এ ভাবেই রাজনৈতিক দিক থেকে বাধা প্রাপ্ত হয়েছে বার বার। শাসক চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের বৈঠকে কী কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা প্রকাশ্যে জানানো হয় না। ফলে দেশের ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েন।
সামগ্রিক ভাবে চিন সরকারের ঋণের পরিমাণও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বর্তমান ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র চেয়ে তিন গুণ বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেজিংকে আরও বেশি সাবধানী হতে হবে। ঋণের পরিমাণ কমিয়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে লভ্যাংশ বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকতে হবে জিনপিং সরকারকে।
চিনের অর্থনীতির এক চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে রিয়েল এস্টেট। তা স্থিতিশীল করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে বেজিংকে। রিয়েল এস্টেটে চিনের দুর্বলতা দেশকে বড়সড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড় করাতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
এই পরিস্থিতিতে চিন সরকার কী পদক্ষেপ করবে, রাজনৈতিক কড়াকড়ি শিথিল করে বাণিজ্যিক লাভের দিকে নজর দেবে কি না, তা জিনপিংয়ের উপরেই নির্ভর করছে।
তবে চিন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হলে সারা বিশ্বেই তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। কারণ চিন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনৈতিক মানের বিচারে আমেরিকার পরেই তার স্থান।