যে কোনও দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের সাপেক্ষে দেশটির নিজস্ব মুদ্রার মানের উপর। মুদ্রাস্ফীতির অর্থ টাকার দাম পড়ে যাওয়া। আর তার ফলে হু হু করে বৃদ্ধি পায় জিনিসপত্রের দাম।
কোনও দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক এই মুদ্রাস্ফীতি। এর ফলে সাধারণ মানুষের রোজগার নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অর্থনীতির বাজারে তাই মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধির মতো শব্দ পরিচিত। এই পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়। সকলেই চান, জিনিসের দাম কমে যাক, বৃদ্ধি পাক রোজগার। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতেরই এক পড়শি দেশ বিপরীত কামনা করছে।
কথা হচ্ছে চিনকে নিয়ে। সেখানে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ পাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ক্রমে সঙ্কট আরও তীব্র হচ্ছে।
চিনে সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাস্ফীতি নয়, ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, দেশটিতে টাকার দাম প্রয়োজনের অধিক বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছে। জিনিসের দাম গিয়েছে কমে।
প্রাথমিক ভাবে শুনে মনে হতে পারে, ‘মুদ্রাসঙ্কোচনের’ ফলে চিনের মানুষের সুবিধাই হয়েছে। কম দামে বেশি জিনিস কিনতে পারছেন তাঁরা। অধিক সঞ্চয়ও হচ্ছে। আর ভাবনা কিসের?
কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির মতো ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’ও যে কোনও দেশের অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলতে পারে। চিন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তার উপর ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’-এর প্রভাব অন্য দেশগুলির আকাশেও ঘনিয়ে তুলতে পারে সঙ্কটের মেঘ।
ঠিক কী ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে চিনে? দেশটির খুচরো পণ্যের বাজারে ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’-এর প্রভাব দেখা গিয়েছে। জুলাই মাসে খুচরো পণ্যের দাম কমেছে। যা গত দু’বছরে কখনও ঘটেনি।
পরিসংখ্যান বলছে, চিনের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচক জুলাই মাসে গত বছরের তুলনায় ০.৩ শতাংশ কমেছে। এই পরিসংখ্যান জিনপিং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
কোভিড অতিমারিতে দীর্ঘ লকডাউনের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, রোজগার থমকে ছিল। অতিমারি পর্বের পরেই তাই বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ জমানো টাকা বেশি করে খরচ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
অধিক খরচের ফলে উৎপাদিত পণ্যের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়ে গিয়েছিল। দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় দেশে দেশে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু চিনে এর বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
চিনে জিনিসপত্রের উৎপাদন হ্রাস পায়নি। কিন্তু কমেছে সাধারণ মানুষের চাহিদা। সেই কারণেই ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’ দেখা দিয়েছে। দাম কমলেও কেউ সেই জিনিস কিনছেন না। কারণ, তাঁদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস উৎপন্ন হচ্ছে।
দেশটির আমদানি এবং রফতানির পরিসংখ্যানও বেশ দুর্বল। কোভিড অতিমারিতে চিনের অর্থনীতিতে যে সার্বিক ধাক্কা লেগেছিল, তা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি জিনপিং সরকার। এই পরিসংখ্যান সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
বেকরত্ব বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে চিনে। চলতি বছরে ১ কোটি ১৫ লক্ষের বেশি পড়ুয়া চিনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোবেন। তাঁদের চাকরির বাজারে জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
জিনিসের দাম কমে যাওয়ায় ঋণের বোঝা লাঘব করাও চিন সরকারের কাছে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধি চাইছে চিন। কিন্তু সরকারের হাতে এই মুহূর্তে তেমন কোনও উপায় নেই, যা ‘মুশকিল আসান’ হতে পারে।
চিনের ‘মুদ্রাসঙ্কোচনের’ প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বের অন্য দেশগুলির উপরেও। কারণ, সারা বিশ্বে প্রচুর জিনিস রফতানি করে চিন। সেখানে জিনিসের দাম কমে গিয়েছে। সস্তার চিনা পণ্যে বাজার ছেয়ে গেলে অন্য দেশের নির্মাতা এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হতে পারে।
জিনিসের দাম কমে যাওয়ায় বিভিন্ন চিনা সংস্থার মুনাফা কমে গিয়েছে। ভবিষ্যতে এর ফলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ, কোনও সংস্থাই আর নতুন করে নিয়োগে আগ্রহী নয়।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চিনের রফতানি জুলাই মাসে গত বছরের তুলনায় ১৪.৫ শতাংশ কমেছে। আমদানি হ্রাস পেয়েছে ১২.৪ শতাংশ। চাহিদা কমে যাওয়ায় চিনের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে।
বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহকদের মধ্যে উৎসাহ বৃদ্ধি ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’-এর সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার চাবিকাঠি হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনের মানুষের হাতে অনেক টাকা চলে আসায় তারা এখন সঞ্চয়ী হয়ে উঠেছেন।
সঞ্চয়ের পরিবর্তে খরচ এবং বিনিয়োগের উৎসাহ দিতে হবে চিনের বাসিন্দাদের। তবেই অর্থনীতি সচল হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।