রবিবার সকাল থেকেই রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়কের বাড়ি-সহ অন্তত এক ডজন জায়গায় তল্লাশি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
রবিবার প্রথমে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের চেতলার বাড়িতে যায় সিবিআইয়ের একটি দল। তার পরই জানা যায় যে, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্রের ভবানীপুরের বাড়িতেও হানা দিয়েছে সিবিআই।
কামারহাটি পুরসভার অন্তর্গত দক্ষিণেশ্বরের যে আবাসনে মদন থাকেন, সেখানেও হানা দিয়েছে সিবিআইয়ের তিন সদস্যের একটি দল।
রবিবার সকালে সিবিআইয়ের একটি দল চেতলায় ফিরহাদের বাড়িতে পৌঁছয়। বাড়ির ভিতর ঢুকে তল্লাশি চালানো শুরু করে তারা। বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি ঘিরে রাখেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানেরা। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ব্যাপক কড়াকড়ি করা হয়।
ফিরহাদের বাড়ির সামনে জড়ো হন তাঁর অনুগামীরা। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন অনেকে। ওঠে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি-বিরোধী স্লোগান। তাঁদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণেই এই সিবিআই হানা। বাড়ির বাইরে সিআরপিএফ জওয়ানদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন ফিরহাদ-কন্যা প্রিয়দর্শিনী হাকিম।
বেলা গড়ালে জানা যায়, শুধু ফিরহাদ-মদনের বাড়িতেই নয়, হালিশহর এবং কাঁচরাপাড়া পুরসভার দুই প্রাক্তন পুরপ্রধানের বাড়িতেও হানা দিয়েছে সিবিআইয়ের দল।
তার পর সময় যত এগোতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে সিবিআই-তল্লাশি চলছে, এমন বাড়ির সংখ্যা। দুপুরের দিকে জানা যায়, একসঙ্গে তল্লাশি চলছে কাঁচরাপাড়া, ব্যারাকপুর, হালিশহর, দমদম, উত্তর দমদম, কৃষ্ণনগর, টাকি, কামারহাটি পুর এলাকায়।
সিবিআই সূত্রে জানা যায়, রবিবার সাতসকালে প্রচুর সংখ্যক সিআরপিএফ জওয়ানকে নিয়ে কলকাতার নিজাম প্যালেসের দফতর থেকে বেরোন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। সোজা ঢোকেন ফিরহাদের বাড়িতে। অন্য দিকে, সিবিআইয়ের একটি দল যায় কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্রের ভবানীপুরের বাড়ির দিকে।
আরও কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাজ্যের একাধিক পুরসভার প্রাক্তন এবং বর্তমান পুরপ্রতিনিধিদের বাড়িতে পৌঁছে যান সিবিআই আধিকারিকেরা।
সিবিআইয়ের চার সদস্যের একটি দল যায় হালিশহর পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান অংশুমান রায়ের বাড়িতে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হালিশহরের পুরপ্রধান ছিলেন ওই তৃণমূল নেতা। তাঁর বাড়ির আলমারি ঘেঁটে কাগজপত্র বার করা হয়।
কাঁচরাপাড়া পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান সুদমা রায়ের বাড়িতেও সিবিআই তল্লাশি শুরু হয়েছে। সুদমার এক ঘনিষ্ঠ জানান, প্রাক্তন পুরপ্রধানের কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র খতিয়ে দেখছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী অফিসাররা।
সিবিআইয়ের আরও একটি দল পৌঁছয় কৃষ্ণনগর পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান অসীম সাহার বাড়িতে।
নিউ ব্যারাকপুর পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান তৃপ্তি মজুমদারের বাড়িতে সিবিআই হানার খবর মেলে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে তৃপ্তির বাড়িতে গিয়েছেন সিবিআই আধিকারিকেরা।
দমদম পুরসভার বর্তমান পুরপ্রধান হরেন্দ্র সিংহের বাড়িতেও চলছে সিবিআইয়ের তল্লাশি অভিযান। উত্তর দমদমের প্রাক্তন পুরপ্রধান সুবোধ চক্রবর্তীর বাড়িতেও গিয়েছে সিবিআইয়ের একটি দল।
কিন্তু কী কারণে এই তল্লাশি অভিযান? সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরসভায় নিয়োগকাণ্ডের তদন্তেই তাদের এই তল্লাশি অভিযান।
পুরসভায় একাধিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তর অনিয়ম এবং চাকরির বিনিময়ে টাকার লেনদেন হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে আদালতে জানানো হয়। এই মামলার তদন্তে আগেও রাজ্যের একাধিক পুরসভার আধিকারিকদের নথি নিয়ে তলব করা হয়েছিল।
স্কুলে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্ত চালাতে গিয়ে পুরসভায় নিয়োগ ‘দুর্নীতি’র বিষয়টি উঠে আসে। তৃণমূলের বহিষ্কৃত যুবনেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতারের পরে তাঁদের ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার অয়ন শীলের নাম উঠে আসে।
অয়নের সল্টলেকের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন পুরসভায় নিয়োগ সংক্রান্ত নথি উদ্ধার করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাঁর ওই অফিস থেকে পুরসভার বিভিন্ন পদে চাকরিপ্রার্থীদের উত্তরপত্র বা ওএমআর শিট (উত্তরপত্র) পাওয়া গিয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন তদন্তকারীরা।
কাঁচরাপাড়া, টাকি, দক্ষিণ দমদম, হালিশহর, বরাহনগর-সহ বহু পুরসভায় নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতিতে অয়ন জড়িত ছিলেন বলে দাবি করা হয়।
গত এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতিতে তদন্ত করতে পারবে সিবিআই। তাঁর নির্দেশ ছিল, প্রয়োজন মনে করলে নতুন এফআইআর দায়ের করে তদন্ত করতে পারবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি।
সেই নির্দেশ পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিল রাজ্য। তাদের পুনর্বিবেচনার আর্জি খারিজ করে আগের নির্দেশ বহাল রাখেন বিচারপতি অমৃতা সিংহ।
পরে সিঙ্গল বেঞ্চের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় রাজ্য। কিন্তু সেই নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়নি ডিভিশন বেঞ্চ। এর পরই গত ২৪ এপ্রিল এই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় একটি এফআইআর করে তদন্তে নামে সিবিআই।
এর পরে উত্তর ২৪ পরগনা-সহ অন্যান্য জেলায় মোট ১৪টি পুরসভায় তল্লাশি চালায় তদন্তকারী সংস্থাটি। ওই সব পুরসভা থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রচুর নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে দাবি করা হয়।
এর আগে রাজ্যের আর এক মন্ত্রীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল আর এক তদন্তকারী সংস্থা ইডি। পুর নিয়োগ মামলায় ৫ অক্টোবর রথীন ঘোষের বাড়িতে গিয়েছিলেন ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকেরা।
গভীর রাত পর্যন্ত সেই তল্লাশি চলেছিল। সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পর রাত পৌনে ২টো নাগাদ তদন্তকারীরা রথীনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।
শুধু রথীন নন, একই দিনে ১০ থেকে ১২টি দলে ভাগ হয়ে বরাহনগর, সল্টলেক-সহ মোট ১২টি জায়গায় হানা দিয়েছিল ইডি।
কামারহাটি পুরসভার তৃণমূলের পুর চেয়ারম্যান গোপাল সাহার অমৃতনগরের বাড়ি, বরাহনগর পুরসভার চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিকের বাড়ি এবং টিটাগড়ের প্রাক্তন পুর চেয়ারম্যান প্রশান্ত চৌধুরীর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে।
রবিবার দলের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে সিবিআই-হানা নিয়ে তৃণমূলের বক্তব্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজভবনের সামনে ধর্নার পাল্টা হিসাবে সিবিআইকে ব্যবহার করছে বিজেপি।
এ নিয়ে তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘বিজেপির উপর চাপ বাড়ছে... তাই নজর ঘোরাতে রাজনৈতিক পরিকল্পনায় আবার নামানো হল এজেন্সিকে।’’
পাশাপাশি, কুণাল বলেন, ‘‘এ ভাবে তৃণমূলকে দমানো যাবে না।’’ অন্য দিকে, বিজেপির বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সংস্থা তাদের কাজ করছে। এখানে রাজনীতির কোনও ব্যাপার নেই।