বাস্তবের ‘মানি হেইস্ট’। জমজমাট হোটেল। সেখানে ঢুকেছিলেন একা চোর। আর ঢুকে লুট করেছিলেন কোটি কোটি টাকার হিরে, মূল্যবান পাথরের গয়না। জনসমক্ষে। সবাই হতবাক। তবু চোরকে কিছু করতে পারেননি। এ যেন আসলেন, দেখলেন আর জয় করলেন! কার্লটন হোটেলের সেই চুরির ধাঁধা আজও সমাধান হয়নি।
ফ্রান্সের কান শহরে রয়েছে বিখ্যাত কার্লটন হোটেল। বয়স ১০০ বছর ছাড়িয়েছে। ১৯৫৫ সালে এই হোটেলই ছিল আলফ্রেড হিচককের ‘টু ক্যাচ আ থিফ’ ছবির প্রেক্ষাপট। সেখানেই যে পরবর্তী কালে এ রকম ভয়ঙ্কর চুরি হবে, তা কি তখন কেউ জানতেন?
ছবিতে অভিনয় করেছিলেন গ্রেস কেলি। পরে যত বারই কান চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন গ্রেস, এই হোটেলেই উঠেছেন। সেই হোটেলেই ২০১৩ সালে হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক চুরি।
দিনের আলোয় হোটেল থেকে চুরি গিয়েছিল ১৩৬ মিলিয়ন ডলারের গয়না। ভারতীয় মুদ্রায় যার দাম প্রায় ১,১২০ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা। চুরির পর প্রশ্নের মুখে পড়েছিল স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
কার্লটন হোটেলে প্রায়ই গয়নার প্রদর্শনী হত। ২০১৩ সালে চুরির সময়েও এমন এক প্রদর্শনীই চলছিল। ইজরায়েলের এক ব্যবসায়ী লেভ অ্যাভনেরোভিক লেভিয়েভ নিজের সংস্থার গয়নার প্রদর্শনী করেছিলেন। সেখান থেকেই চুরি গিয়েছিল কোটি কোটি টাকার গয়না।
দলবল নিয়ে আসেননি চোর। এসেছিলেন একা। মাথায় একটা বেসবল ক্যাপ ছিল। আর গলায় মাফলার। এমন ভাবে সব পরেছিলেন, যে কেউ আর খেয়ালই করেননি তাঁর মুখ। লক্ষ্যও করেননি। সেই সুযোগটাই নিয়েছিলেন চোর। এ যেন ‘ধুম ২’ ছবির হৃতিক রোশন।
সঙ্গে ছিল একটি মাত্র হ্যান্ডগান। তা দিয়েই ভয় দেখিয়ে তুলে নিয়েছিলেন হিরে, জহরত। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কারণ তাঁদের হাত ছিল শূন্য। কারও হাতে কোনও অস্ত্রই ছিল না। তা নিয়ে পরে প্রশ্ন উঠেছে অনেক। কী ভাবে এত বড় হোটেলের নিরাপত্তা এত ঢিলেঢালা হতে পারে!
চোর যদিও আটঘাট বেঁধেই এসেছিলেন। আগে থেকে খোঁজ নিয়ে রেখেছিলেন সব। জানতেন যে, কার্লটন হোটেলের নিরাপত্তা কতটা ঢিলেঢালা ছিল। ওই ঘটনার কিছু দিন আগেই হোটেলের একটি পার্টি থেকে এক মহিলার হিরের হার চুরি হয়ে যায়।
পার্টিতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন ওই মহিলা। তাঁর গলা থেকে ২৬ লক্ষ ডলারের হার চুরি হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় মুদ্রায় তার দাম ছিল প্রায় ২১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। ওই ঘটনার কয়েক দিন আগে হোটেলে থাকতে আসা এক অতিথির লকার থেকে চুরি যায় ১০ লক্ষ ডলারের গয়না। ভারতীয় মুদ্রায় যার দাম প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা।
সবেরই খোঁজ রেখেছিলেন ‘চোরবাবাজি’। পরে সুযোগ বুঝে তার সদ্ব্যবহার করেন। হোটেলে ঢুকে পিস্তল দেখিয়ে গুনে গুনে ৭২টি গয়না নিজের সুটকেসে ভরেন। তার মধ্যে ৩৪টি ছিল ব্যতিক্রমী গয়না। বিরল জহরতে তৈরি। গোটা ঘটনায় এক জনের গায়েও আঁচড় পড়েনি।
পুলিশের অনুমান ছিল, পিঙ্ক প্যান্থার নামে একটি গ্যাংয়ের সদস্যেরা এই কাজ করেছেন। ওই গ্যাংয়ের সদস্যেরা ছিলেন মূলত যুগোস্লাভিয়ার। পুলিশের সন্দেহ ছিল ওই গ্যাংয়ের সদস্য মিলান পপারিকের উপর।
৩৪ বছরের মিলান গয়না চুরিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আদতে বসনিয়ার বাসিন্দা। সুইৎজারল্যান্ডে একটি গয়নার দোকানে চুরি করে ২০০৯ সালে জেলে গিয়েছিলেন। ন’বছরের সাজা হয়েছিল তাঁর।
২০১৩ সালের জুলাইয়ে ওই চুরির ঘটনা ঘটে। তার কয়েক দিন আগে জেল থেকে পালিয়েছিলেন মিলান। সাজার মেয়াদ তখনও শেষ হয়নি। ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর আর খোঁজও মেলেনি। তবু পুলিশ তাঁকে ধরতে পারেনি।
তবে তদন্তকারীদের একাংশ মনে করেছিলেন, অভিযুক্ত কোনও গ্যাংয়ের সদস্য নন। তিনি একাই গোটা পরিকল্পনা করেছেন। তার পর দিনক্ষণ বুঝে চুরি করেছেন। অনেকের দাবি ছিল, মিলানই চুরি করেছিলেন। তবে নিজের দলের কাউকে আর ভাগ দেননি।
শেষ পর্যন্ত ওই চুরির ঘটনায় কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি ছিল, হোটেলের অবস্থান এমন ছিল যে, চোরের পালাতে সুবিধা হয়েছিল। প্রমেনাদ দে লা ক্রোয়াসেতে ছিল সেই বিলাসবহুল হোটেল। ফ্রেঞ্চ রিভেরার ধারে। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন সেই চোর। তার পর হয়তো পালিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে।