প্রতিভার ছটায় টেলিভিশন আলো করলেও বলিউডে নাম কামাতে পারেননি বহু অভিনেতাই! তবে নব্বইয়ের দশকে সে ধারণা ভেঙে চুরমার করে দেন এক ছিপছিপে তরুণ। তথাকথিত নায়কসুলভ চেহারা নয়। পেশির দাপট নেই। নেই চমকদার নাচের দক্ষতাও। এত ‘খুঁত’ সত্ত্বেও কখন যেন বলিউডে রাজত্ব করতে শুরু করে দিয়েছেন। ছোট থেকে বড় পর্দায় তাঁর উত্তরণের কাহিনি শোনাতে গেলে সে ছিপছিপে তরুণ বলতেই পারেন, ‘নাম তো শুনা হি হোগা!’
শাহরুখের নাম শোনেননি, এমন বলি-প্রেমী অলীক কল্পনা! দূরদর্শনের পর্দায় টেলি-সিরিয়াল ‘দিল দরিয়া’, ‘ফৌজি’, ‘সার্কাস’। তার পর একলাফে বলিউডে প্রবেশ। ১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ হয়ে গিয়েছিলেন শাহরুখ। বাকিটা ইতিহাস! ’৯২-এর ওই ফিল্মের পর দুনিয়াই বদলে গিয়েছিল শাহরুখের। তবে অনেকেরই হয়তো মনে নেই শাহরুখের মতোই সিরিয়ালের পর্দা থেকে বলিউডে জেঁকে বসেছেন বহু অভিনেতা।
হিন্দি-সহ সাতটি ভাষায় ফিল্ম করে ফেলেছেন। তবে তামিল, তেলুগু এবং হিন্দি ফিল্মেই আর মাধবনের বেশি যাতায়াত। দক্ষিণী ফিল্মে রোমান্টিক নায়ক হোক বা বলিউডের একঝাঁক তারকায় ভরা বিগ বাজেটের ফিল্ম— অনায়াসে পার করেছেন মাধবন। এক দিকে গৌতম মেননের পরিচালনায় ‘মিন্নালে’ বা মণি রত্নমের ‘আলায়পয়ুতে’-র মতো ফিল্মে রোম্যান্টিক হিরোর ভূমিকায়। অন্য দিকে, রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ‘রং দে বসন্তী’, রাজকুমার হিরানির ‘থ্রি ইডিয়টস’ বা মণি রত্নমের ‘গুরু’— অনায়াস যাতায়াত মাধবনের।
ফিল্মি পর্দায় কাজের আগে টেলিভিশনেও প্রায় সমান হিট ছিলেন মাধবন। নব্বইয়ের দশকে এক ঝকঝকে স্মার্ট নৌসেনা অফিসারকে দেখতে অনেকেই টিভি খুলে বসতেন। দূরদর্শনের মেট্রো চ্যানেলে ‘সি হকস’ তখন তুমুল জনপ্রিয়। তবে সেই সিরিয়াল ছাড়াও ’৯৩-তে ‘ইউল লভ স্টোরিজ’, ‘বনেগি আপনি বাত’, ‘ঘরজামাই’, ‘সায়া’ বা ‘তোল মোল কে বোল’— একের পর এক টিভি শোয়ে নিজের টিআরপি বাড়িয়েছেন মাধবন।
অনেকে মনে করেন, বলিউডি নায়িকাকে নতুন ভাবে চিনতে শিখিয়েছেন বিদ্যা বালন। ‘পরিণীতা’র ধ্রুপদী খোলস বদল করে কখনও নিজের ‘কহানি’ লিখেছেন। আবার কখনও সোচ্চার হয়েছে ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’-তে। আবার ‘লাগে রহো মু্ন্নাভাই’-এর পর ‘দ্য ডার্টি পিক্চার’ দিয়ে ছক বদলেছেন। খান বা কপূরদের ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বিদ্যা।
বলিউডে নিজের রাজত্ব গড়ে তোলার বহু আগে সিরিয়ালেও দাপট দেখিয়েছিলেন বিদ্যা। সাল ১৯৯৫। ‘হম পাঁচ’-এর মতো ‘সিটকম’-এ রাধিকা মাথুরকে আজও মনে রেখেছেন অনেকে।
শাহরুখের মতোই বলিউড-যাত্রার আগে টেলিভিশনের জমিয়ে বসেছিলেন পুলকিত সম্রাট। তবে বলিউডে সুপারস্টারের তকমা না পেলেও ছাপ ফেলেছেন ‘ফুকরে’ পুলকিত। দিল্লির আনাচকানাচে পড়ে থাকা টুকরোটাকরা জীবনকে ‘ফুকরে’-তে নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
২০১৩ সালে ‘ফুকরে’ করার আগে থেকেই অবশ্য টেলিভিশনে তারকার তকমা পেয়ে গিয়েছিলেন পুলকিত। ‘কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি’-তে নজর কেড়েছেন। মৌনী রায়কে সঙ্গে নিয়ে ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’-তে মধ্যমণি হয়ে বসেছেন।
চণ্ডীগড়ের থিয়েটারের মঞ্চ থেকে বলিউডের অনিশ্চিত জীবন। তবে বেপাড়ায় গিয়েও নিজের জমি নিশ্চিত করেছেন আয়ুষ্মান খুরানা। নিত্যদিনের খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত থেকে কঠিন মুখের পোড়খাওয়া পুলিশ— সবেতেই সমান সাবলীল। নায়কোচিত হাবভাব নয়, বরং ‘আম আদমি’কে নিজের অভিনয়ে তুলে এনেছেন আয়ুষ্মান। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। পারিশ্রমিকের নিরিখে বলিউডে প্রথম সারিতে থাকলেও কবিতা লেখা বন্ধ করেননি ‘ভিকি ডোনর’। ‘দম লাগা কে হেইশা’, ‘বরেলী কি বরফি’, ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’, ‘বাধাই হো’, ‘অন্ধাধুন’, ‘আর্টিক্ল ১৫’—একের পর এক হিট ফিল্মে সমালোচকেরা মন খুলে আয়ুষ্মানের প্রশংসা করেছেন।
বড় পর্দায় নজরে পড়ার আগে টিভি শোয়ে মুখ দেখিয়েছিলেন আয়ুষ্মান। ২০০৪ সালে ‘এমটিভি রোডিজ’-এর মতো রিয়ালিটি শো। তার পর ‘কয়ামত’ এবং ‘এক থি রাজকুমারী’-এর মতো সিরিয়াল। কম কাজ করলেও তা নজরে পড়েছিল।
ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে ইয়ামি গৌতমের মুখ দেখে অনেকেই বলতেন, ঠিক যেন বলিউডের নায়িকা! পরে সে কথাই হুবহু মিলে গিয়েছে। ‘ভিকি ডোনর’-এর মতো রোমান্টিক কমেডিতে বলিউডে প্রবেশ। তার পর ‘বদলাপুর’, ‘কাবিল’, ‘সনম রে’ বা ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মতো ফিল্ম। ধীরে হলেও বলিউডে জমি কাড়ছেন ইয়ামি।
২০১২ সালে ‘ভিকি ডোনর’-এর বহু আগে টেলি-সিরিয়ালেও মুখ দেখিয়েছিলেন ইয়ামি। ২০০৮-এ ‘চাঁদ কে পার চলো’। প্রায় দু’বছর পর ‘ইয়ে প্যায়ার না হোগা কম’। ছোট পর্দায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ইয়ামি।
খান পদবিধারী। তবে প্রচলিত অর্থে বলিউডের সুপারস্টার নন। তাতে কী! বড় পর্দায় নিজস্ব জমি দখল করে নিয়েছিলেন ইরফান খান। বলিউড তো বটেই, ব্রিটিশ এবং হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ইরফানের অভিনয়ের ভাষায় মুগ্ধ অনেকেই। মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’-তে পত্রলেখকের ছোট্ট রোল ছিল তাঁর। ১৯৮৮ সালে সেই অভিষেকের দীর্ঘ দিন পর ‘লাইফ ইন আ... মেট্রো’, ‘লাঞ্চবক্স’, ‘পান সিং তোমর’, ‘হাসিল’, ‘মকবুল’, ‘পিকু’, ‘নেমসেক’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘ইনফারনো’, ‘স্লামডগ মিলিয়োনেয়ার’, ‘হায়দর’— ইরফানের ফিল্মের সংখ্যা যেন শেষ হতেই চায় না।
৫৩ বছরে তাঁর জীবন থেমে গেলেও ইরফানকে মনে রেখেছেন সিনেমাপ্রেমীরা। যে ভাবে সিরিয়ালে বুঁদ দর্শকেরাও তাঁকে ভোলেননি। শ্যাম বেনেগালের ‘ভারত এক খোঁজ’ থেকে ‘চাণক্য’, ‘চন্দ্রকান্তা’, ‘বনেগি আপনি বাত’, ‘জাস্ট মহব্বত’, ‘মানো ইয়া না মানো’— এককালে ছোট পর্দায়ও চুটিয়ে কাজ করেছেন ইরফান।
চল্লিশের দশকে ফিল্ম প্রযোজক ছিলেন আদিত্য রায় কপূরের ঠাকুরদা রঘুপত রায় কপূর। দাদা সিদ্ধার্থ রায় কপূরও সে পথের পথিক। তবে মেজ’দা কুণাল রায় কপূরের মতোই ফিল্মের অভিনয়ে বেশি আগ্রহী আদিত্য। ‘আশিকি ২’ বা ‘ওকে জানু’-র নায়ক আবার রণবীর কপূরের পাশে ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’-তেও মন খুলে ব্যাটিং করেছেন। আবার স্বমহিমায় দেখা গিয়েছে ‘মলং’ বা ‘লুডো’-তে।
টেলি-সিরিয়ালে অভিনয় নয়, বরং সঞ্চালক হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন আদিত্য। একঝাঁক কোঁকড়া চুলের ঝুঁটি বাঁধা আদিত্যকে এককালে দেখা গিয়েছে ‘ইন্ডিয়াজ হটেস্ট’ বা ‘পাকাও’-এর মতো শোয়ের সঞ্চালনা করতে।