১৯৮৭ সাল। সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যা। ঠান্ডা তখনও তেমন জাঁকিয়ে বসেনি। আমেরিকা জুড়ে মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করছেন সকলে। তেমনই এক সন্ধ্যায় জট পাকিয়েছিল রহস্যের জাল।
আমেরিকার জর্জিয়া প্রদেশের রাজধানী আটলান্টা। সেই শহরের বাসিন্দা ছিলেন মিনি উইনস্টন এবং উইলিয়াম উইনস্টন। সত্তরোর্ধ্ব এই দম্পতির বাড়ি থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। সেই বাড়ির ‘রক্তাক্ত’ ইতিহাস আজও ভুলতে পারেননি অনেকে।
মিনির বয়স ৭৭ বছর। জানা যায়, ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বৃদ্ধা স্নান সেরে সবেমাত্র বেরিয়েছিলেন। তাকিয়ে দেখেন, স্নানঘরের মেঝেয় চাপ চাপ রক্ত লেগে রয়েছে। কোথা থেকে সেই রক্ত এল বুঝতে পারেননি তিনি।
বৃদ্ধা প্রথমে নিজের শরীর খুঁটিয়ে দেখেন, কোথাও কোনও রক্তের চিহ্ন সেখানে ছিল না। তিনি খেয়াল করেন, স্নানঘরের মেঝেতে বিন্দু বিন্দু রক্তের পরিমাণ ক্রমে বাড়ছে। তিনি ছুটে যান স্বামীর কাছে।
মিনির স্বামী উইলিয়ামের বয়স ৭৯ বছর। তিনি শোয়ার ঘরে ঘুমোচ্ছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে থতমত খেয়ে উঠে বসেন বৃদ্ধ। স্নানঘরের সামনে গিয়ে তাঁরা দু’জনেই ভাল করে রক্তের ধরন পরীক্ষা করে দেখেন।
প্রাথমিক ভাবে দম্পতির ধারণা হয়, কোনও ধেড়ে ইঁদুর বা অন্য কোনও জন্তু আহত অবস্থায় তাঁদের বাড়িতে ঢুকেছে। কিন্তু সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। বরং যা মিলেছে, তা আরও ভয়ানক।
উইনস্টন দম্পতি দেখেন, শুধু স্নানঘর নয়, সারা বাড়ি থেকেই রক্ত ঝরছে। প্রতিটি ঘরের দেওয়াল, দরজা, জানলার খাঁজ, এমনকি বাড়ির বেসমেন্টেও লেগে আছে রক্ত। সারা বাড়ি লালে লাল হয়ে গিয়েছে। যেন গোটা বাড়ি থেকেই কোনও কারণে রক্তপাত হচ্ছে।
দম্পতি পুলিশ ডাকেন এর পর। পুলিশ এসে প্রথমে দেখে তাঁদের বাড়িতে কেউ এসেছিলেন কি না বা কেউ লুকিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিলেন কি না। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু মেলেনি।
উইনস্টনদের এই বাড়ি ঘিরে রহস্য ক্রমেই বাড়তে থাকে। পুলিশ আধিকারিক থেকে শুরু করে দুঁদে গোয়েন্দা, কেউ কোনও ভাবেই রক্তের উৎস খুঁজে পাননি। ওই বাড়িতে কোনও পোষ্যও ছিল না। দম্পতি একাই থাকতেন। এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত বিস্ময়কর’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
কেউ কেউ দাবি করেছিলেন, আসলে জংমিশ্রিত লালচে তরল পাওয়া গিয়েছে দম্পতির বাড়িতে। তা হয়তো রক্ত বলে ভুল করছেন কেউ কেউ। তবে পরীক্ষা করে সেই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেন বিশেষজ্ঞেরা।
পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, বাড়ির দেওয়াল থেকে রক্তই ঝরেছে। এবং তা কোনও পশুপাখির নয়। মানুষের রক্ত। শুধু তা-ই নয়, ও গ্রুপের রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল ওই বাড়ির দেওয়াল এবং মেঝে থেকে।
উইনস্টন দম্পতির রক্তের গ্রুপ এ। ফলে দেওয়ালের রক্ত তাঁদের শরীরের নয়। তাঁদের পরিবারেও ও গ্রুপের রক্ত কারও ছিল না। দীর্ঘ দিন ধরে এই ঘটনার তদন্ত চলে। পুলিশ শূন্যে উত্তর হাতড়ে বেরিয়েছে কেবল, কোনও সুরাহা মেলেনি এই রুধির রহস্যের।
ক্রমে উইনস্টনদের বাড়িটি গোটা আমেরিকায় চর্চার কেন্দ্রে উঠে আসে। দিনরাত সেখানে সংবাদমাধ্যমের ভিড় লেগে থাকত। দেওয়ালে দেওয়ালে তাক করা থাকত ক্যামেরা। ‘রক্তাক্ত’ বাড়িটিকে শুধু চোখের দেখা দেখতেই ভিড় করতেন অনেকে।
বাস্তবে যখন উত্তর মেলে না, মানুষ অবাস্তবের আশ্রয় নেয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন, এটি সম্পূর্ণ ভূতুড়ে কাণ্ড। উইনস্টনদের বাড়িতে কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল কি না, পুলিশও সেই প্রশ্ন করেছে বার বার।
কিন্তু তেমন কিছু কখনও চোখে পড়েনি বলেও দাবি করেন দম্পতি। তাঁরা জানান, গত ২২ বছর ধরে ওই বাড়িতেই তাঁরা বাস করছেন। কখনও অস্বাভাবিক কোনও ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি।
পুলিশ জানায়, বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক ভাল ছিল না। তাঁদের এক মেয়ে হাসপাতালে কাজ করতেন। বাবা-মাকে পাগল প্রতিপন্ন করে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি বাড়িতে রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কি না, উঠেছিল সেই প্রশ্নও।
এ ছাড়া, উইলিয়াম নিজে ডায়ালিসিসের রোগী ছিলেন। রক্ত তাঁর কাছেও ছিল সহজলভ্য। তিনিও কোনও কারণে রক্ত ছড়িয়েছিলেন কি না, খতিয়ে দেখেছিল পুলিশ। কিন্তু পুলিশের এ সব কোনও তত্ত্বই টেকেনি উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে।
বৃদ্ধ দম্পতির বাড়িতে কী হয়েছিল, কেন দেওয়াল থেকে আচমকা ঝরতে শুরু করেছিল ও গ্রুপের রক্ত, এ সব প্রশ্ন আজও রহস্য থেকে গিয়েছে। পুলিশ যার পর্দা উন্মোচন করতে পারেনি। এই বাড়ির কাহিনি নিয়ে পরে বইও লেখা হয়েছে।