Begum Akhtar

Begum Akhtar: ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা, গর্ভপাত... অতীত নয়, কণ্ঠের জন্যই আখতারিবাইকে স্মরণ করল গ্র্যামির মঞ্চ

তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু তথ্যচিত্র। তার মধ্যে একটি সাহিত্য আকাদেমি প্রযোজনা করেছে। নাম ‘জিকর উস পরিবাস কা’।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:০৩
Share:
০১ ৪১

মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও তাঁকে নিয়ে, তাঁর জীবন নিয়ে, জীবনের নানা ওঠাপড়া নিয়ে চর্চা। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রথম গ্র্যামি জয়ী আরুজ আফতাব স্বীকার করেছেন, তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণা বেগম আখতার।

০২ ৪১

আরুজ বলেছেন, যাঁদের গান থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে এক জন যেমন আবিদা পারভিন, অন্য জন বেগম আখতার। আখতারিবাইয়ের গজল, ঠুংরি এখনও তাঁকে টানে। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু তথ্যচিত্র। তার মধ্যে একটি সাহিত্য আকাদেমি প্রযোজনা করেছে। নাম ‘জিকর উস পরিবাস কা’। যা একাধিক পুরস্কারও পেয়েছে।

Advertisement
০৩ ৪১

কেন বেগম আখতারের জীবন নিয়ে এখনও এত আগ্রহ? আগ্রহ এই কারণে যে, আখতারির জীবনে এসেছে বহু ওঠাপড়া। কিন্তু সে সব কাটিয়ে তিনি স্বকীয় স্থান তৈরি করেছেন। যে কারণে মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও গ্র্যামির মঞ্চে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম।

০৪ ৪১

এখনও বিতর্ক হয় তাঁর গাওয়া গান রিমেক করে হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করা নিয়ে। যেমন হয়েছিল মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত ‘দেড় ইশকিয়া’ ছবিতে বেগম আখতারের ‘হামরি অটরিয়া পে আও সাঁবরিয়া’ গানটি ব্যবহার নিয়ে। পাশের ছবিটি বেগমের উপর তৈরি একটি তথ্যচিত্র থেকে নেওয়া।

০৫ ৪১

আখতারির জীবনের সঙ্গে কলকাতা ছিল নিবিড় ভাবে জড়িয়ে। জীবনে প্রথম স্টেজে অনুষ্ঠান এই শহরেই। এক শিল্পী শেষ মুহূর্তে আসেননি। তখনই স্টেজে তুলে দেওয়া হয় আখতারিকে।

০৬ ৪১

স্মৃতিচারণে আখতারি বলেছিলেন, ‘‘আমি এর আগে কখনও স্টেজে অনুষ্ঠান করিনি৷ এত মানুষ স্টেজের উপর থেকে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাব৷ একটু বেশি ক্ষণ সময় নিয়েছিলাম গান ধরতে৷ সে সময় আল্লাহকে বলেছিলাম, শক্তি দিতে৷ মুমতাজ বেগমের গাওয়া আমার সব চেয়ে প্রিয় ওই গজল দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করি৷ গলা ফেলার পর অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম৷’’

০৭ ৪১

স্টেজ থেকে নামতে না নামতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন কিছু গুণমুগ্ধ৷ তাঁদের মধ্যে এক জন বলেছিলেন, ‘‘আমি এখানে আসার সময় ভেবেছিলাম, কিছু ক্ষণ থেকে চলে যাব৷ কিন্তু তুমি আমাকে গোটা অনুষ্ঠান বসে থাকতে বাধ্য করলে৷ আমি আজ তোমার অনুষ্ঠান শুনলাম৷ তুমি আগামী কাল আসবে আমার অনুষ্ঠানে৷’’

০৮ ৪১

বক্তার নাম সরোজিনী নাইডু৷ যিনি পরের দিন একটা খাদির শাড়ি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন আখতারিকে৷ গান গেয়ে সেটাই ওঁর পাওয়া প্রথম কোনও উপহার৷

০৯ ৪১

ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের তওয়াইফ সম্প্রদায়ের বলতে গেলে শেষ বাইজি আখতারিবাই ফৈজাবাদির জীবনের শুরুতেই পেয়েছেন একাধিক ধাক্কা।

১০ ৪১

ফৈজাবাদ জেলার এক অখ্যাত শহরে জন্ম৷ মা মুস্তারির প্রেমে পড়েছিলেন বাবা আসগর হুসেন৷ লখনউয়ের আইনজীবী হুসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী মুস্তারি৷ যিনি নিজেও ছিলেন তওয়াইফ৷ বিয়ের কিছু দিন পরই মুস্তারি ও তাঁর মেয়েদের তাড়িয়ে দেন আসগর৷ মেয়েদের নিয়ে মুস্তারি চলে আসেন ফৈজাবাদ৷ আখতারির জীবনে এটাই প্রথম বিচ্ছেদ৷ বাবাকে জীবনভর খুঁজে গিয়েছেন। কখনও যোগাযোগ হয়েছে, কখনও হয়নি৷ এ কথা সত্যি, যে ভাবে বাবাকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন, সে ভাবে পাননি৷ মা এবং যমজ বোনের সঙ্গে এর পর বেঁচে থাকার লড়াই৷ এই লড়াইয়ের মধ্যেই দ্বিতীয় বিচ্ছেদ৷

১১ ৪১

তখন বয়স মাত্র চার৷ বিষ মেশানো মিষ্টি খেয়ে হাসপাতালের পথেই মারা যায় বোন জোহরা৷ ছোট্ট বিবি (আখতার) তার সব সময়ের সঙ্গীকে খুঁজে যায়। পায় না৷ মাকে বারবার জিজ্ঞাসা করে বোনের কথা। মা বলে, ‘বোন গিয়েছে আল্লাহের বাড়ি…।’ বহু দিন পর্যন্ত আখতারি জানতই না, বোন সত্যিই কোথায়।

১২ ৪১

পরের ধাক্কা তাঁর এক গুরুর কাছে। ঘনিষ্ঠ এক ছাত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের স্বনামধন্য সেই শিল্পী পরমা সুন্দরী আখতারিকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি।

১৩ ৪১

তারও পরে বিহারের এক প্রদেশের সঙ্গীত পৃষ্ঠপোষক রাজার লালসার শিকার হতে হয়। আখতারির এক মেয়ে হয়। লোকলজ্জার হাত থেকে ছোট্ট আখতারিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন মা মুস্তারি। চাউর করে দেন, নবজাতিকা তাঁরই আত্মজা। আমৃত্যু সেই মেয়েকে বোন বলে এসেছেন আখতারিবাই। বয়স তখন মাত্র ১৩!

১৪ ৪১

পরে লখনউয়ের প্রসিদ্ধ ব্যারিস্টার ও কাকলির নবাব ইশতিয়াক আহম্মদ আব্বাসি বিয়ে করলে, অযোধ্যার ‘উচ্চবিত্ত’ সম্প্রদায়ের মধ্যে আখতারি অন্য ভাবে সমাদৃত হন। বাইজি থেকে বেগম হন আখতারি।

১৫ ৪১

নবাবের সঙ্গে অবশ্য আলাপ হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। ১৯৩৪ সালে লখনউয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন আখতারি। আব্বাসি তখন তরুণ আইনজীবী। আখতারির গাড়ি তাঁকে আর একটু হলেই চাপা দিচ্ছিল। কোনও রকমে সে যাত্রা রক্ষা পান নবাবজাদা। এর পর দীর্ঘ আলাপে প্রেম। ক্রমে আখতারির গানে মজে যান তিনি। শেষে বিয়ে।

১৬ ৪১

আখতারিবাই বেগম হলেন ঠিকই, কিন্তু একটা শর্তও ছিল সেই বিয়েতে। কী সেই শর্ত? সাধারণ আসরে গান গাইতে পারবেন না বেগম। মেনে নিয়েছিলেন। হয়তো নিজেও চেয়েছিলেন একেবারে ঘরোয়া জীবন, গ্ল্যামার থেকে বিরতি। কিন্তু ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বেগমসাহেবা। বছর কয়েক এই ভাবে কাটিয়ে চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা জানান, কোনও ওষুধে এই রোগ সারবে না। ওঁকে গানে ফেরাতে হবে।

১৭ ৪১

১৯৪৯ সালে লখনউ রেডিয়োয় তিনটে গজল আর একটা দাদরা রেকর্ড করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, সেই গান ব্রডকাস্টের সময় তাঁকে বেগম আখতার বলে সম্বোধন করা হয়। রেকর্ডিং করে এত আনন্দ পান, যে বাড়ি ফিরে অঝোরে কেঁদে ফেলেন। পরবর্তীকালে কোনও বড় অনুষ্ঠানের পরও যে ছবি ঘনিষ্ঠরা দেখেছেন। যে মা জীবনভর তাঁকে আগলে রেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যু এর কয়েক বছর পর।

১৮ ৪১

শোনা যায়, মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে যখন সমাধিস্থ করা হচ্ছে, তখন সেই সমাধিতে নেমে পড়েন আখতারি। সেখান থেকে কিছুতেই উঠে আসতে চাইছিলেন না। শেষে গানের কথা বলে তাঁকে ফেরানো হয়। জীবনভর এমন ছোট-বড় নানা দুঃখ থেকেই উৎসারিত তাঁর সব গান।

১৯ ৪১

কাকার ইচ্ছেতেই গান শুরু। মাত্র সাত বছর বয়সে। যাযাবর থিয়েটার কোম্পানির চন্দাবাইয়ের কাছে হাতে খড়ি। এর পর পাটনার প্রখ্যাত সারেঙ্গি বাদক ইমদাদ খাঁ (যিনি সে সময় নিয়মিত মলকাজান ও গহরজানের সঙ্গে বাজাতন), পাটিয়ালার আতা মহম্মদ খাঁ, লাহোর নিবাসী কিরানা ঘরানার আবদুল ওয়াহিদ খাঁ, গয়ার জমির খাঁ, জুন্দা খাঁ, উস্তাদ বরকত আলি খাঁ (উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ভাই)য়ের কাছেও শিখেছেন।

২০ ৪১

নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরে কলকাতায় আসা। নাটকের পাশাপাশি জলসাতেও গান করতেন। কলকাতার সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলে গান শেখা থামেনি। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছেন। লখনউতে চলে গেলেও কলকাতা প্রায় আসতেন রেকর্ডিংয়ের জন্য। জে এন ঘোষের মেগাফোন কোম্পানিতে ১০ বছরের চুক্তি ছিল। কখনও থেকেছেন ট্যাংরায়, কখনও রিপন স্ট্রিটে মজিদ খাঁ সাহেবের (কেরামৎ খাঁ সাহেবের বাবা) বাড়ির কাছে ভাড়া বাড়িতে। কখনও উঠেছেন বৌবাজারে। কখনও হোটেল ব্রডওয়ে। নিরিবিলি যে হোটেল সে সময় অনেক গাইয়ে-বাজিয়েরই পছন্দ ছিল।

২১ ৪১

কলকাতায় থাকাকালীন অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই প্রথম রেকর্ডিং করতে হয়। এইচএমভির হয়ে আখতারির প্রথম কিছু গজল ও ঠুংরি রেকর্ড করেন। যার মধ্যে একটা গজল ছিল ‘বো আসীরে দাম-এ-বলা হুঁ ম্যায়’। এই গান এত জনপ্রিয় হয় যে ওঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

২২ ৪১

অভিনেত্রী নার্গিসের মা গায়িকা জদ্দনবাই যুবতী আখতারির উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁকে দেখেই মুম্বই যাওয়ার সিদ্ধান্ত আখতারির। তিনের দশক। কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি তাঁকে ‘এক দিন কা বাদশা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়।

২৩ ৪১

এর পর ‘আমিনা’, ‘রূপ কুমারী’-সহ করেকটি ছবিতে অভিনয়। পরে লখনউ ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে পরিচালক মেহবুব খান তাঁকে ‘রোটি’ ছবিতে অভিনয় ও গান করার কথা বলেন। আখতারি রাজি হন। সেই ছবির সুরকার ছিলেন অনিল বিশ্বাস। বিয়ের পর থেকে অভিনয়েও নিষেধাজ্ঞা ছিল। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও তাঁর স্মরণীয় গান আছে। প্রখ্যাত সব সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।

২৪ ৪১

‘জলসাঘর’ ছবিতে সত্যজিৎ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের গান শোনার যে দৃশ্যপট এঁকেছিলেন, সেখানে সত্যিকারের এক বাইজির দরকার ছিল। উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ ও তাঁর ছোট ভাই ইমরাতও সঙ্গীত পরিচালনা করতে গিয়ে সেটা বুঝেছিলেন। আখতারিবাই ছাড়া আর কারও কথা ভাবা যেত না সে সময়।

২৫ ৪১

সত্যজিৎ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমরা লখনউ গেলাম। ওঁকে বললাম। শুরুর দিকে উনি রাজি হননি। আমার এক আত্মীয় তখন লখনউয়ের ব্যারিস্টার। উনি আখতারির স্বামীর ভাল বন্ধু। শেষে উনিই রাজি করান।’’

২৬ ৪১

ছবিতে দুর্গাবাই হিসেবে আখতারির গান ‘ভরভর আয়ি আঁখিয়া পিয়া বিন’ এবং তার সঙ্গে রোশনকুমারীর নাচ এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

২৭ ৪১

সেটা ১৯২৫। বিভিন্ন জলসায় গান-রেকর্ডিং যখন চলছে, তখন আখতারি মোটের উপর ঠিক করে নেন, তিনি সঙ্গীত শিল্পীই হবেন। এক দিন মাকে সে কথা বলেন। মা খুবই চিন্তায় পড়েন। আখতারিকে নিয়ে যান বরেলি শরিফে এক সুফি পীরের কাছে। তাঁকে সমস্যার কথা জানান। সঙ্গে উদ্বেগ, মেয়ে বিবাহযোগ্যা। মায়ের প্রশ্ন, এমতাবস্থায় তাঁর কী করণীয়?

২৮ ৪১

পীরবাবা আখতারির চোখের দিকে তাকান। তার পর, তার সবচেয়ে প্রিয় গজল বেছে দিতে বলেন। আখতারি তাঁর সামনে বইয়ের একটা পাতা মেলে ধরেন, যেখানে অন্য গানের সঙ্গে তাঁর প্রিয় গজলটিও ছিল। পীরবাবা একটি বিশেষ গানে হাত রাখেন এবং পরবর্তী অনুষ্ঠান ওই গজল দিয়ে শুরু করতে আদেশ করেন। সেই গজলটি— দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো, দিওয়ানা বানা দে।

২৯ ৪১

এইচএমভি গানটি রেকর্ড করে। সেই গান এত জনপ্রিয় হয়, যে এইচএমভির সব রেকর্ড নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাজারে জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে না, বরং চাহিদা বাড়তে থাকে লাফিয়ে। ইংল্যান্ড থেকে রেকর্ডের কপি করে যা পূরণ করা এক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ভারতে ‘রেকর্ড প্রেসিং প্লান্ট’ নিয়ে আসতে বাধ্য হয় এইচএমভি।

৩০ ৪১

এত বছর পার করে এসেও কেন এত জনপ্রিয় আখতারিবাইয়ের গান? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভূত তালিম ওঁর ঠুংরি-দাদরা-গজলে অদ্ভুত ভাবে মিশে যেত। রাগের মধ্যে যে অনুরাগ থাকে, সেটা বড় মিষ্টি করে উনি ব্যবহার করতেন। কখনও খেয়ালের সঙ্গে ফোক মিশিয়েছেন, কখনও গজলের সঙ্গে দাদরা। পাশাপাশি, উপস্থাপনের সময় তাঁর স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারতেন। গজল গাওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চারণ, আবেদন এবং গায়ন শৈলী বদলে আধুনিকতার ছোঁয়া আনেন আখতারি। যা ছিল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ভাবনা-চিন্তার ফসল।

৩১ ৪১

আখতারির আগে গহরজান, মলকাজান বা জোহরাবাইয়ের আমলে একভাবে গজল গাওয়া হত। সেই ছক ভেঙে তিনি বেরোতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল সে সময়ের বিশ্রুত ঊর্দু কবি মির তাকি মির, শাকিল বাদাউনি বা কইফি আজমির মতো একাধিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। এই জন্যই তো তিনি ‘মল্লিকা-এ-গজল’। রসুলন বাইয়ের সঙ্গে ছবিতে আখতারিবাই।

৩২ ৪১

জীবনভর স্বীকৃতিও কম পাননি। পাকিস্তান-আফগানিস্তান বা রাশিয়া গিয়েছেন ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে। পদ্ম সম্মান ও সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত। কিন্তু বিভিন্ন সময় একের পর এক ধাক্কা এবং একাকিত্ব ক্রমশই তাঁকে ঠেলে দেয় বিভিন্ন নেশার মধ্যে দিয়ে নিজের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখার দিকে।

৩৩ ৪১

ঘনিষ্ঠ ছাত্রীর লেখা থেকে যা জানা যায়, মানসিক যন্ত্রণা এড়াতে বেশ কয়েক বার গর্ভপাত করতে হয়েছে। বয়সের সঙ্গে শরীরও খারাপ হয়ছে।

৩৪ ৪১

সেটা ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪। আমদাবাদে সেই অনুষ্ঠান নিয়ে মারাত্মক উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। প্রচার করা হয়, বেগম সাহেবার ৬০ বছরের জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠান। বেগমও নিজে সেই অনুষ্ঠান নিয়ে উত্তেজিত।

৩৫ ৪১

শরীর ঠিক ছিল না। ইতিমধ্যেই দু’বার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীর দুর্বল। তার ওপর জ্বর। তবু, উৎসাহে ঘাটতি পড়েনি। কইফি আজমি একটা গজল লিখেছিলেন, বেগম আখতারের ৬০ বছরের জন্মদিন মনে রেখে। সে গানও তো গাইতে হবে।

৩৬ ৪১

ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়াম। পর্দা ওঠামাত্র হাততালিতে অভিবাদন। সামান্য মাথা নামিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করে বেগম গলা ফেললেন। কিন্তু শান্তি পেলেন না। স্কেল চড়িয়ে নিলেন। ফের বাঁধলেন তানপুরা। একের পর এক অনুরোধে জনপ্রিয় সব গান তাঁকে করেই যেতে হল উঁচু স্কেলে।

৩৭ ৪১

শেষ অনুরোধ। আরও একটা গান। ফের হারমোনিয়ামে সুর তুলতে হল। ‘অ্যায় মোহাব্বত, তেরি আনজাম পে রোনা আয়া’— না শুনে তাঁকে ছাড়বেন না কেউ। গানের মাঝখানে মঞ্চেই তৃতীয় বার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে যেতে হল। তিন দিন বাদে মৃত্যু।

৩৮ ৪১

পুরনো লখনউ শহরের হজরতগঞ্জ এলাকার কেন্দ্রে বেগম হজরত মহল পার্ক। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের স্ত্রী হজরত মহল সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রায় এক বছর লখনউয়ের দখল রাখেন নিজের হাতে। তাঁর স্মৃতিজড়িত সেই পার্ক পেরিয়ে গেলে গোমতী নদীর পাড় বরাবর কিছু দূর এগোলে ঠাকুরগঞ্জ এলাকা। সেখানেই অমরগঞ্জে গ্রিনল্যান্ড পার্কের কাছে রয়েছে বেগম আখতারের সমাধি।

৩৯ ৪১

বেগম আখতারের সমাধিতে গেলে চোখে পড়বে লাল ইটের দেওয়াল ঘেরা ছোট্ট চালা। পাশাপাশি শ্বেতপাথরে বাঁধানো দু’টি সমাধি। একটি মা মুশতারিবাইয়ের। পাশেরটি আখতারির।

৪০ ৪১

সম্প্রতি বেগম আখতারের জীবন নিয়ে ইংল্যান্ডে তৈরি হয়েছে ‘মিউজিক্যাল’। গান, অভিনয় মিলিয়ে যে ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

৪১ ৪১

ঋণ: বেগম আখতার, দ্য কুইন অফ গজল, সুতপা মুখোপাধ্যায়, রূপা অ্যান্ড কোং। দিওয়ানা বানানা হ্যায়, মেগাফোন, পরিচিতি: জয়দেব মুখোপাধ্যায়। অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ক্লাসিকাল মিউজিক, বিজয়প্রকাশ সিংহ, রোলি বুকস। তহজীব-এ-মৌসিকী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, বাউলমন প্রকাশন। অ্যায় মোহাব্বত: রেমিনিসিং বেগম আখতার, রীতা গঙ্গোপাধ্যায় ও জ্যোতি সভারওয়াল, স্টেলার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। জলসাঘর ছবির গান নিয়ে অ্যাড্রু রবিনসনকে দেওয়া সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement