জাতীয় রাজনীতিতে আবার আলোচনার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে ‘বিশেষ রাজ্যের তকমা’র বিষয়টি। কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ শরিক তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ)-এর তরফে যথাক্রমে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারকে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।
টিডিপি নেতা তথা অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং জেডিইউ নেতা তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার দীর্ঘ দিন ধরে তাঁদের রাজ্যকে বিশেষ রাজ্যের তকমা বা স্পেশাল ক্যাটাগরি স্টেটাস (এসসিএস) দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। এ বার লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে সরকার বাঁচাতে দুই শরিকের এই দাবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাও পদ্মশিবিরের পক্ষে কঠিন।
বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রধান অন্তরায় চতুর্দশ অর্থ কমিশনের একটি প্রস্তাব। ২০১৫ সালে কমিশন এই বিশেষ তকমা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কেন্দ্রের তৎকালীন বিজেপি সরকার এই প্রস্তাব গ্রহণও করে। তবে অর্থ কমিশন ওই বছরেই ১১টি রাজ্যকে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
বর্তমানে বিশেষ তকমা পাওয়া এই রাজ্যগুলি হল অসম, নাগাল্যান্ড, হিমাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, সিকিম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, মিজ়োরাম, উত্তরাখণ্ড এবং তেলঙ্গানা।
ভারতের সংবিধানে অবশ্য এই বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার কোনও সংস্থান রাখা হয়নি। তবে ঐতিহাসিক কারণেই কিছু রাজ্য যে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় খানিক পিছিয়ে রয়েছে, তা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
এই স্বীকারোক্তির সূত্র ধরেই ১৯৬৯ সালে পঞ্চম অর্থ কমিশনের প্রস্তাব মেনে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়া শুরু হয়। তবে শর্ত ছিল যে, সেই বিশেষ তকমা পাওয়া রাজ্যকে পর্বতশঙ্কুল হতে হবে, মোট জনসংখ্যার বড় অংশকে তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হবে। কিংবা সেই রাজ্যটির জনঘনত্ব অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম হতে হবে।
তা ছাড়াও রাজ্যটি যদি কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, দেশের সীমান্তবর্তী কোনও এলাকায় অবস্থিত হয় এবং সেখানে যদিও অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত পশ্চাদপদতা থাকে, তবে সেই রাজ্য বিশেষ তকমা পাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠতে পারে।
কোনও রাজ্য এই বিশেষ তকমা পেলে একাধিক সুবিধা পেয়ে থাকে। সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বিশেষ রাজ্যের তকমা পাওয়া রাজ্যগুলিকে কেন্দ্র ৯০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। বাকি ১০ শতাংশের সংস্থান করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যটি বা রাজ্যগুলি।
সাধারণত অন্য যে কোনও সাধারণ রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে কেন্দ্র এবং রাজ্যের অর্থ বরাদ্দের অনুপাত ৬০-৪০ কিংবা ৭৫-২৫। অর্থাৎ, কেন্দ্র ৬০ কিংবা ৭৫ শতাংশ টাকা দিলে রাজ্যগুলিকে ৪০ কিংবা ২৫ শতাংশ টাকা দিতে হয়।
তা ছাড়া মোট কেন্দ্রীয় বাজেটের ৩০ শতাংশ সরাসরি বরাদ্দ করা হয় বিশেষ রাজ্যের তকমা পাওয়া রাজ্যগুলিতে। চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই রাজ্যগুলির প্রাপ্য করের পরিমাণ ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪১ শতাংশ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, বিহার কেন বিশেষ রাজ্যের তকমা পাওয়ার আর্জি জানাচ্ছে? বিহার প্রশাসনের বক্তব্য, তাদের একাধিক অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, সে ভাবে ওই রাজ্যে শিল্পোন্নয়ন হয়নি। বড় অঙ্কের বিনিয়োগও আসেনি।
বিহার সরকারের যুক্তি, ঝাড়খণ্ড আলাদা রাজ্য হয়ে যাওয়ার পর একাধিক খনি, শিল্প সব ‘নিয়ে’ গিয়েছে। ফলে বিহারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে গিয়েছে। দেখা গিয়েছে শিল্প, কর্মসংস্থান এবং খনিজ পদার্থের আকাল।
বিহারের নীতীশ সরকারের ঝুলিতে আরও যুক্তি রয়েছে। তাদের বক্তব্য, সাম্প্রতিক জাতগণনায় দেখা গিয়েছে বিহারের এক তৃতীয়াংশ মানুষ দরিদ্র। তাই তাঁদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন।
বিহারের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬০ হাজার টাকা, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশ কম। এই সমস্ত মাপকাঠিতে ফেলে বিচার করলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে বিহার বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্ত। বিহারের আর্থ-সামাজিক অনুন্নতি রোধে যে বহুমুখী পদক্ষেপ করা প্রয়োজন, ২০১৩ সালেই তা স্বীকার করে নেয় রঘুরাম রাজন কমিটি।
কিন্তু এর উল্টো অভিমতও আছে। অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কোনও রাজ্য যদি অর্থনৈতিক ভাবে বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় গলদ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে উন্নত রাজ্যগুলির কাছ থেকে অধিক কর আদায় করে কেন এই রাজ্যগুলিকে ভর্তুকি দেওয়া হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তা ছাড়া কিছু রাজ্যকে এই বিশেষ তকমা দিলেও অন্য রাজ্যগুলিও এই একই দাবি জানাবে। সবার দাবিকে মান্যতা দিতে হলে রাজকোষের উপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।
ঐতিহাসিক ভাবেই বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বেশ মন্থর এবং এই দুই রাজ্যেই দারিদ্র প্রশাসকদের কাছে মাথাব্যথার বিষয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মূলত সরকারগুলির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, সকলের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ তৈরি করতে না পারাকে দোষ দেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তা ছাড়া বিহারে কোনও পার্বত্য এলাকা নেই। বিহারের ভৌগলিক অবস্থানকেও স্পর্শকাতর কিংবা দেশের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলা চলে না। প্রায় একই যুক্তি খাটে অন্ধ্রের ক্ষেত্রেও।
চন্দ্রবাবুর যুক্তি শিল্পসমৃদ্ধ হায়দরাবাদ তেলঙ্গানায় চলে যাওয়ায় ভাঁড়ারে টান পড়েছে অন্ধ্রের। কিন্তু তার জন্য দক্ষিণের এই রাজ্যকে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার আর্জি কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে যে, বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলগুলি রাজনৈতিক স্বার্থে এই তকমাকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। যেমন অন্ধ্রকে বিশেষ রাজ্যের তকমা না দেওয়ায় ২০১৮ সালে এনডিএ ছেড়ে দেন চন্দ্রবাবু। জানা গিয়েছিল, ঘরোয়া রাজনীতিতে চাপের মুখে পড়েই তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি অন্ধ্রের জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ক্ষমতায় এসে বিশেষ রাজ্যের তকমা ছিনিয়ে আনবেন।
ছ’বছর পর ফের এনডিএ-সঙ্গী হয়ে চন্দ্রবাবু ফের নিজের পুরনো দাবিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তবে কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০১৫ সালে দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, অধুনা প্রয়াত অরুণ জেটলি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন, বিশেষ রাজ্যের তকমা না দেওয়া হলেও অন্ধ্রকে বেশ কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে।
আগে বিশেষ তকমা পাওয়া রাজ্যগুলিকে অর্থ বরাদ্দ করত প্ল্যানিং কমিশনের অধীনস্ত সংস্থা জাতীয় উন্নয়ন কাউন্সিল। এখন অবশ্য প্ল্যানিং কমিশনই নেই। তার পরিবর্তে এসেছে নীতি আয়োগ।
তবে বিশেষ রাজ্যের তকমা পাওয়ার বিষয়টি এখন অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক মানদণ্ডে নয়, এখন রাজনৈতিক ভাবেই নির্ধারিত হবে। কারণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে বিহার এবং অন্ধ্রকে কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে পারে কেন্দ্র। কিন্তু সেটিকে সরকারি ভাবে বিশেষ রাজ্যের তকমা বলা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ তফসিলি জাতি এবং জনজাতিভুক্ত, এই যুক্তি দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিশেষ রাজ্যের তকমা চাইছে ওড়িশাও। সম্প্রতি সে রাজ্যে নবীন পট্টনায়কের বিজেডিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। এখন ওড়িশা নিয়েও বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার কী ব্যবস্থা নেয়, সে দিকে নজর রয়েছে সকলের।