অলিম্পিক্সের প্রথম সোনা জয়ের কয়েক বছরের মধ্যে আচমকাই সাঁতারের পুলকে বিদায় জানিয়েছিলেন। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় তাঁর জীবন ঘুরপাক খেত অজস্র নারীসঙ্গ এবং মাদকের অন্ধকার জগতে।
সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মধ্য তিরিশে সাঁতারের পুলে ফিরে অলিম্পিক্সে সোনা জেতেন অ্যান্টনি লি আরভিন।
মধ্য তিরিশে অলিম্পিক্সের ব্যক্তিগত ইভেন্টে নেমে সবচেয়ে বেশি বয়সি আমেরিকান হিসাবে সোনা জয় করেছিলেন আরভিন। তাঁর জীবনের চরাই-উৎরাইয়ের কাহিনিতে নাটকীয় চিত্রনাট্যের যাবতীয় মশলা মজুত রয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্ল্যারিটা শহরের ভ্যালেন্সিয়া এলাকায় বে়ড়ে উঠেছিলেন এই প্রাক্তন সাঁতারু। ছোটবেলায় ‘টরেট সিনড্রোম’-এ ভুগতেন তিনি। তাতে ক্রমাগত চোখমুখের পেশি কুঁচকে যেত।
চোখ-মুখের এই ভঙ্গির জন্য কম কটূক্তি শুনতে হয়নি তাঁকে। তবে কম বয়স থেকে সাঁতারের মতো ব্যায়ামের ফলে সে সমস্যা কমে গিয়েছিল। ২০১৭ এবং ’১৮ সালে টরেট অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকার দূতও হয়েছিলেন আরভিন।
হাইস্কুলের সাঁতারুদের দলে অন্যতম নাম ছিলেন তিনি। তবে সাঁতারের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষার দিকেও ঝুঁকেছিলেন আরভিং। ২০১০ সালে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হন।
২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক্সে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল এবং ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে জোড়া পদক জিতেছিলেন ১৯ বছর বয়সি আরভিন। ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে রিলেতে গ্যারি হল জুনিয়র, নীল ওয়াকার এবং জেসন লেজ়াকের আগে নিজের ‘লেগ’ শেষ করেছিলেন ৪৮.৮৯ সেকেন্ডে। অস্ট্রেলিয়ার পিছনে থেকে রুপো পাওয়ার পথে আমেরিকার দলটি সময় নেয় ৩.১৩.৮৬ মিনিট।
৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে অবশ্য সোনা জিতে নিয়েছিলেন আরভিন। সময় নিয়েছিলেন ২১:০৮ সেকেন্ড। আরভিনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আফ্রিকান এবং ইহুদি। সুরিনামের অ্যান্টনি নেস্টির পর সেই প্রথম আফ্রিকান জনজাতির কোনও সাঁতারু সোনা জিতলেন।
স্বাভাবিক ভাবেই আরভিনকে ঘিরে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি আরভিন। পরের বছর জাপানের ফুকুওকোয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল এবং ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ব্যক্তিগত ইভেন্টে জোড়া সোনা জয় করেন।
২০০২ সালে প্যান প্যাসিফিক সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল এবং ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতেও আবার জোড়া রুপো জয়। যদিও মাত্র ২২ বছর বয়সে সাঁতার ছেড়ে অন্য পথে পা বাড়ান আরভিন।
কম বয়সে খ্যাতির আলো পেলেও তাকে হেলায় সরিয়ে দিয়েছিলেন আরভিন। পরে ‘রোলিং স্টোন’ পত্রিকায় তিনি জানিয়েছিলেন, সাঁতারকে ছাপিয়ে অন্য সব কিছুই গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল তাঁর জীবনে।
সাঁতারকে বিদায় জানিয়ে নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে শুরু করেন আরভিন। একটি মিউজ়িক ব্যান্ডের দলেও যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় থেকে শুরু হয়েছিল মদ্যপান, মাদক সেবন এবং অজস্র নারীসঙ্গ।
আরভিন পরে স্বীকার করেছিলেন, ওই বছরগুলি তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারময় পর্ব ছিল। এক বার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। আরভিং বলেছিলেন, ‘‘পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছিল, নিজেকে শেষ করে দিতেও ব্যর্থ আমি।’’
আরভিনের কথায়, ‘‘মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে ফিরে মনে হয়েছিল ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হল। এক ভাবে বলতে গেলে নবজন্ম হয়েছিল আমার।’’
এক বার পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য মোটারবাইক দুর্ঘটনার কবলেও পড়েন আরভিন। বহু নারীর সঙ্গেও যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন তিনি।
সে সব দিনের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আরভিন বলেন, ‘‘আমার মনে হয় না, আমিই ওই ব্যক্তি। নিজেকে সামলাতে পারিনি। তবে এখন মনে হয়, ও ভাবে বাঁচা যায় না।’’ রিহ্যাবেও থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
সাঁতারের পুল, অলিম্পিক্সের মঞ্চে আবার দেখা গিয়েছিল আরভিনকে। ১৬ বছরের বিরতির পর ২০১৬ সালের অগস্টে রিয়ো অলিম্পিক্সে ব্যক্তিগত ইভেন্টে নেমেই সোনা জেতেন। ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্ট শেষ করতে সময় নিয়েছিলেন ২১.৪০ সেকেন্ড।
রিয়োর জল থেকে সোনা তুলে নেওয়ার সময় আরভিংয়ের বয়স ছিল ৩৫। তবে এক সময় এতটাই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলেন যে, সিডনি অলিম্পক্সে জেতা সোনার পদকও ১৭,০০০ ডলারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। যদিও অনেকের মতে, সুনামি দুর্গতদের সাহায্যেই পদক বিক্রি করেছিলেন আরভিন।