শিয়ালদহের দিকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। মালগাড়ির ধাক্কায় ট্রেনের পিছন দিকের দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়েছে বলে খবর। মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৮ যাত্রীর। আহত বহু।
বিগত কয়েক দিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে উত্তরবঙ্গে। সোমবার সকাল থেকেও বৃষ্টি চলছে। তার মাঝেই ঘটল এই দুর্ঘটনা। অসমের শিলচর থেকে শিয়ালদহের দিকে আসছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সিগন্যাল লাল থাকায় নীচবাড়ি এবং রাঙাপানি স্টেশনের মাঝে দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটি। তখন সেই লাইনেই এসে পড়ে একটি মালগাড়ি।
পিছন থেকে এসে সজোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে ধাক্কা মারে মালগাড়িটি। সংঘর্ষের অভিঘাতে মালগাড়ির উপর উঠে পড়ে এক্সপ্রেসের পিছনের কামরা। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়িটিও।
উল্লেখ্য, এক বছর আগে, অর্থাৎ গত বছরের জুন মাসেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে পড়ে ভারতীয় রেল।
২০২৩ সালের ২ জুন। ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা প্রায় ৭টা। বালেশ্বরের বাহানগা বাজারের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস, বেঙ্গালুরু হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ির সংঘর্ষ হয়েছিল। ২৯৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই দুর্ঘটনায়। আহত হয়েছিলেন প্রায় ১২০০ জন।
শুধু করমণ্ডল এক্সপ্রেস নয়, ২০২৩ সালে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৭টি রেল দুর্ঘটনা হয়েছে ভারতে। করমণ্ডলের দুর্ঘটনা নিয়ে জুন মাসেই ছ’টি। সেই জুনেই ফের দুর্ঘটনার মুখে পড়ল ভারতীয় রেল। মৃত্যু হল আট জনের।
সোমবারের দুর্ঘটনা নিয়ে রেল সূত্রে খবর, ওই লাইনে সিগন্যালিংয়ের কাজ চলছিল। ট্রেন চালানো হচ্ছিল ম্যানুয়াল সিগন্যালে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ধীরে চললেও গতি কমায়নি মালগাড়িটি। রেলের প্রাথমিক অনুমান, লাল সিগন্যাল মানেননি মালগাড়ির চালক। সেই কারণেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে গিয়ে সেটি ধাক্কা মারে।
সাধারণত যে লাইনে এক্সপ্রেস ট্রেন চলে, সেই লাইনে মালগাড়ি চালানো হয় না। মালগাড়িকে দাঁড় করিয়ে যেতে দেওয়া হয় এক্সপ্রেস। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনেই মালগাড়িটি ছিল।
মনে করা হচ্ছে, একই লাইনে দু’টি ট্রেন পাস করানোর পরিকল্পনা ছিল রেলের। তবে আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে শিয়ালদহের উদ্দেশে রওনা করিয়ে তার পর মালগাড়িকে পাস করানোর কথা। সেই কারণেই মালগাড়িকে লাল সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল।
রেলের অনুমান, মালগাড়ির চালক ওই সিগন্যাল দেখতে পাননি। ফলে একই লাইনে এসে পড়ে মালগাড়িটি। ধাক্কা মারে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন প্রকাশ্যে আসছে। এখন যে কোনও রেল ইঞ্জিনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে। ইঞ্জিনের সামনে নির্দিষ্ট কোনও দূরত্বে যদি কোনও ট্রেন বা অন্য কিছু থাকে, তবে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ওই ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়বে। একে ‘কবজ’ ব্যবস্থা বলা হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে মালগাড়ির ইঞ্জিনে কি সেই ব্যবস্থা ছিল না?
রেল সূত্রে খবর, উদ্ধারকাজ সম্পন্ন হলে পুরো ঘটনাটির উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত করে দেখা হবে।
অক্ষত কামরাগুলিকে নিয়ে শিয়ালদহের দিকে রওনা দিয়েছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনটি। পূর্ব রেলের তরফে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, সোমবার বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে শেষের দিকের চারটি কামরা বাদ দিয়ে ডাউন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের বাকি অংশ যাত্রীদের নিয়ে রওনা দিয়েছে। আলুয়াবাড়ি স্টেশনে দাঁড় করানো হয় ট্রেনটি। সেখানে যাত্রীদের জন্য জল এবং খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
দুর্ঘটনাস্থলে এখনও উদ্ধারকাজ চলছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছে বিএসএফ। তাদের ১০০ জন জওয়ান উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। রয়েছে রাজ্য এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।
বিপর্যয়ের কারণে কলকাতা-শিলিগুড়ি রেল যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। রাজধানী এক্সপ্রেস, বন্দেভারত এক্সপ্রেস-সহ বেশ কয়েকটি ট্রেনের গতিপথ বদল এনেছেন কর্তৃপক্ষ।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর হেল্পডেস্ক চালু করেছে রেল। বেশ কিছু হেল্পলাইন নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। সমস্যায় পড়লে ওই নম্বরগুলিতে ফোন করতে হবে যাত্রীদের।
রেল সূত্রে খবর, মালগাড়ির চালক মারা গিয়েছেন। সহ-চালক জীবিত আছেন, তবে গুরুতর জখম। কাঞ্চনজঙ্ঘার গার্ডও মারা গিয়েছেন। আগে রেল জানিয়েছিল সহকারী চালক মারা গিয়েছেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় রেলওয়ে মেল সার্ভিসের (আরএমএস) এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে সূত্রের খবর। শঙ্করমোহন দাস নামের ওই কর্মী কলকাতার বেলেঘাটার বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। কর্তব্যরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
রেলের তরফে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, মৃতের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। যাঁরা গুরুতর আহত, তাঁরা আড়াই লক্ষ টাকা এবং যাঁরা কম আহত, তাঁরা ৫০ হাজার টাকা করে পাবেন।