পথেঘাটে শোওয়ার জন্য ছিল একটি বেডিং। খিদে মেটাতে সামান্য টিফিন। আজ থেকে প্রায় ৪৭ বছর আগে এ নিয়েই মুম্বইয়ে পৌঁছেছিলেন পটনার এক কিশোর। পুঁজি বলতে ছিল একরাশ স্বপ্ন— মুম্বইয়ে গিয়ে কিছু একটা করতে হবে! সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করেই মায়ানগরীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন অনিল অগ্রবাল। শুধু মুম্বইয়ের জমিতেই নয়, গোটা ভারতেই বিস্তার করেছেন তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।
৬৭ বছরের অনিল এখন দেশের প্রথমসারির শিল্পপতি। তাঁর হাতে গড়া বেদান্ত রিসোর্সেস লিমিটেড আজ খননক্ষেত্রে দেশের অন্যতম বড় বেসরকারি সংস্থা। অনিলের সম্পত্তির পরিমাণ শুনলেও চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হয়। ফোর্বস পত্রিকার দাবি, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা পৌঁছেছে ৩৬০ কোটি ডলারে। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ২৭ হাজার ৫১৩ কোটি ১৮ লক্ষ টাকায়।
অথচ ৪৭ বছর আগে সম্পত্তি তো দূরের কথা, সামান্য একটি বেডিং এবং টিফিন কৌটোয় ভরা খাবার ছাড়া হাতে আর কিছুই ছিল না পটনার এই বাসিন্দার। না! ভুল হল। ছিল দৃঢ়প্রত্যয়। তাকে সম্বল করেই পটনা-মুম্বই উড়ানের টিকিট কেটে তাতে উঠে বসেন অনিল। সেটা ১৯৭৫।
গত ফেব্রুয়ারিতে নিজের জীবনসফরের কিছু অভিজ্ঞতার কথা নেটমাধ্যমে জানিয়েছেন অনিল। বলেছেন, পটনা থেকে বিমান উঠলেও গোটা সফরে ১৯ বছরের সেই কিশোরটি কেন কোনও কথা বলেননি।
সে দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে রয়েছে অনিলের। তাঁর কথায়, ‘‘সেই প্রথম আমি বিমানে উঠলাম। স্কুলছাত্র হিসাবে বিমান ভাড়ায় ছাড় পেয়েছিলাম। তবে পুরো সফরে এক বারও মুখ খুলিনি। ইংরেজিই তো জানতাম না!’’
গোড়ার দিকে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও এক সময় নিজের চেষ্টায় তা রপ্ত করেছিলেন অনিল। আরও রপ্ত করেছিলেন ব্যবসা শুরুর কৌশল। ধীরে ধীরে তা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও অর্জন করেছিলেন।
টুইটারে আরও কিছু কথা শেয়ার করেছেন অনিল। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের ভাগ্য বদলাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুম্বইয়ে আসেন। আমিও তাঁদের এক জন ছিলাম। যে দিন বিহার ছেড়ে শুধুমাত্র একটা টিফিনকৌটো, বেডিং আর দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই পৌঁছেছিলাম, সে দিনের কথা মনে পড়ে।’’
মুম্বইয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে প্রথম বার পা রাখার অভিজ্ঞতা অনিলের কাছে আজও সজীব। লিখেছেন, ‘একটা হলুদ-কালো ট্যাক্সি আর ডাবলডেকার বাস দেখেছিলাম। এ সব তো সিনেমায় দেখেছি! তবে বাস্তবে এই প্রথম দেখলাম।’
বাস-ট্যাক্সি ছাড়াও স্বপ্ননগরীকেও দেখেছিলেন অনিল। তাতেই জমিয়ে বসেন তিনি। শুরুটা করেছিলেন, ধাতব ছাঁটের ব্যবসা দিয়ে। প্রায় সত্তরের দশকে প্রায় ১০ বছর তিনি ওই ব্যবসাই করেছিলেন। ভিন্ রাজ্যের কেব্ল সংস্থাগুলি থেকে ফেলে দেওয়া ধাতব ছাঁট সংগ্রহ করতেন। এর পর তা মুম্বইয়ে নিয়ে গিয়ে বেচে দিতেন।
এক সময় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কেব্ল সংস্থাই খুলে বসেন অনিল। মুম্বইয়ের কালবাদেবী এলাকায় নিজের অফিসও গড়েন। কালবাদেবীতে সে সময় রাস্তার ধারে পুরনো জিনিসপত্র বিক্রিবাটা চলত। বই-টাইপরাইটার থেকে ঘরগেরস্থালির জিনিসপত্র সস্তায় কিনতে ভিড় করতেন লোকজন।
কালবাদেবীতে ৮ বাই ১০ বর্গফুটের একটি খুপরিঘরের অফিসে তিন জন লোকও রেখেছিলেন তিনি। তাতে উপরতলার অফিস থেকে ভাড়া করা টেলিফোন ছিল।
সে ব্যবসা করতে করতেই এ বার জেলি-ফিল্ড কেব্লসের ব্যবসা শুরু করেন। এর পর ১৯৮৬ সালে স্টারলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ খুলে বসেন।
ব্যবসার ক্ষেত্রও বদল করেছেন অনিল। কপার থেকে অ্যালুমনিয়াম প্লান্টের পর এ বার অন্য সংস্থা অধিগ্রহণেও মন দেন। বালকো এবং হিন্দুস্তান জিঙ্ক অধিগ্রহণের পর বিনিয়োগ করতে থাকেন অসংখ্য ব্যবসায়। বেদান্তের প্রতিষ্ঠাতা তথা এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান অনিলের গতি বাড়তেই থেকেছে।
এত বছর পরেও মুম্বইয়ে তাঁর প্রথম দিনের কথা মনে রেখেছেন অনিল। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের ভাগ্য বদলাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুম্বইয়ে আসেন। আমিও তাঁদের এক জন ছিলাম। যে দিন বিহার ছেড়ে শুধুমাত্র একটা টিফিনকৌটো, বেডিং আর দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই পৌঁছেছিলাম, সে দিনের কথা মনে পড়ে।’’
স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে মুম্বইয়ে তো লাখো মানুষের ভিড় হয়। সাফল্য আসে কী করে? অনিলের সহজ দাওয়াই। তিনি বলেন, ‘‘যুবসমাজকে বলব, কঠোর পরিশ্রম করুন। সেই সঙ্গে উঁচু লক্ষ্য রাখুন। যদি দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে প্রথম পদক্ষেপ করা যায়, তবে আপনা থেকেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন!’’