আমেরিকার ঢের আগে পাকিস্তানে লাদেনের ডেরার হদিশ পেয়েছিলেন তিনি। এক বার, দু’বার নয়, মৃত্যুকে হারিয়ে ফিরে এসেছেন বার বার। তাই বাকিরা যখন গা ঢাকা দিয়েছেন, বন্দুকের নলের সামনে এগিয়ে এসেছেন আমরুল্লা সালেহ্। নিজেই নিজেকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, তালিবানের সামনে মাথা নোয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু তালিবানি রক্তচক্ষুর মধ্যে তাঁর অভিসন্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যদিও সে সবের পরোয়া নেই গত দেড় বছর ধরে আশরফ গনির উপরাষ্ট্রপতি থাকা আমরুল্লার। বরং একার সাহসেই তালিবানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘ্যাতে নেমেছেন। শৈশবেই অনাথ হয়ে যাওয়া থেকে দেশের অন্যতম সাহসী গুপ্তচর, পরবর্তী কালে দুঁদে রাজনীতিক, বছর ৪৮-এর আমরুল্লার জীবন হার মানায় রোমাঞ্চ সিনেমাকেও।
১৯৭২ সালে হিন্দুকুশের কোলে পঞ্জসিরে তাজিক পরিবারে জন্ম আমরুল্লার। শৈশবেই মা-বাবাকে হারান। তার পর থেকে একমাত্র বোনকে নিয়ে চড়াই উতরাই। সাবেক সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে ১২ বছর বয়সেই মুজাহিদিনে যোগদান। তৎকালীন মুজাহিদ কম্যান্ডার আহমদ শাহ মাসুদের অধীনে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রশিক্ষণও নেন। তার পর তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু।
অল্প দিনেই মাসুদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আমরুল্লা। আমরুল্লার নাগাল না পেয়ে ১৯৯৬ সালে তাঁর বোনকে নৃশংস অত্যাচারের পর খুন করে তালিবান। সেই নিয়ে পরবর্তী কালে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় লেখা প্রতিবেদনে আমরুল্লা জানান, ওই ঘটনার পর তালিবানের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই পাল্টে যায়। প্রাণ গেলেও কখনও তালিবানের সঙ্গে এক ছাদের নীচে দাঁড়াবেন না তিনি।
মুজাহিদিনে থাকাকালীন মাসুদ এবং ভারতের মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হন তিনি। তালিবানকে রুখতে ভারত থেকে আফগানিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র যেত তাঁর তদারকিতেই। মাসুদের তালিবান বিরোধী নর্দার্ন অ্যালায়্যান্সের সদস্যও ছিলেন আমরুল্লা।
২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সেজে দুই আল কায়দা জঙ্গি মাসুদকে হত্যা করে। তার দু’দিন পরেই আমেরিকার ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালায় আল কায়দা। তার পরই আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় আমেরিকা। ক্ষমতা হারায় তালিবান। আমরুল্লাকে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিয়োরিটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই।
৯/১১ হামলাকারী আল কায়দা এবং তাদের প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল তালিবানের বিরুদ্ধে। সেই সময় তালিবান বিরোধী আমরুল্লাকে লুফে নেয় আমেরিকা। সে দেশের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-কে প্রত্যক্ষ ভাবে তদন্তে সাহায্য করতে শুরু করেন আমরুল্লা।
অন্য দিকে, তালিবানকে উচ্ছেদ করতেও সক্রিয় ভূমিকা নেন তিনি। তাঁর তদারকিতে পাকিস্তান সীমান্তে ঢুকে বহু জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করেন আফগান গুপ্তচররা। প্রাক্তন আফগান প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাজিবুল্লাকে হত্যার জন্য সরাসরি পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-কে দায়ী করেন আমরুল্লা।
২০০৬ সালে তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আমরুল্লা দাবি করেন, পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ সংলগ্ন এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে লুকিয়ে রয়েছেন ওসামা বিন লাদেন। পাকিস্তান ওসামাকে আশ্রয় দিয়েছে। তার মাসুল গুনতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে।
শোনা যায়, আমরুল্লার কথা শুনে এতটাই রেগে যান মুশারফ যে টেবিলে জোরে ঘুসি মারেন তিনি। রেগেমেগে বৈঠক বাতিল করে দেন। তবে আমরুল্লার দাবিই সত্যি প্রমাণিত হয়। ২০১১ সালে অ্যাবোটাবাদে পাক সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অদূরেই লাদেনের হদিশ মেলে। আমেরিকার সেনা সেখানে ঢুকেই তাঁকে হত্যা করে ।
২০১০ সালে কারজাই সরকার থেকে বেরিয়ে যান আমরুল্লা। কারজাই তালিবানের প্রতি নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। কারজাইয়ের সঙ্গ ছেড়ে বসেজ-ই-মিল্লি নামে নিজের আলাদা দলও গড়েন আমরুল্লা।
২০১৭ সালে আশরফ গনি সরকারে যোগ দেন আমরুল্লা। ২০১৮ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী পদে বসেন। ২০২০ সালে দেশের উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। গত ১৫ অগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের দখল নিলে প্রথমে শোনা যায় আমরুল্লাও গনির মতো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। কিন্তু তিনি টুইট করে জানিয়ে দেন, আফগানিস্তানেই রয়েছেন। মাথা নোয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। তালিবানের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করছেন।
শুধু তাই নয়, গনির অনুপস্থিতিতে নিজেকে দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও ঘোষণা করেন আমরুল্লা। জানিয়ে দেন, আপসের প্রশ্নই ওঠে না। বুধবার ‘গুরু’ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদ এবং গনি সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিসমিল্লা খান মহম্মদির সঙ্গে মিলে পঞ্জসিরে তালিবানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতে তিনিই নেতৃত্ব দেন।
আমরুল্লাকে একাধিক বার হত্যার চেষ্টাও করেছে তালিবান। ২০১৯ সালে কাবুলে আমরুল্লার দফতরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় তালিবান। তাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়। চার তলার জানলা থেকে পাশের বাড়ির ছাদে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচান আমরুল্লা। ২০২০-র ৯ সেপ্টেম্বরে ফের তাঁর উপর হামলা হয়। সে বার বিস্ফোরণে আহতও হন ।
পরবর্তী কালে সংবাদমাধ্যমে আমরুল্লা জানান, ২০১৯-এর হামলায় তাঁর এক দেহরক্ষীও মারা যান। হাসপাতালে তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে গেলে ওই দেহরক্ষীর এক আত্মীয় তাঁকে চড় মারেন। বাধা দিতে গেলে সকলকে আটকে দেন তিনি ওই ব্যক্তিকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘আরও মারুন আমাকে। আরও মারুন।’’
আমরুল্লা বলেন, ‘‘আমি ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করি, আমি মরলে কি যন্ত্রণা কমবে আপনার? জবাব আসে হ্যাঁ। তৎক্ষণাৎ ওঁর হাতে নিজের পিস্তলটা ধরিয়ে দিই আমি। গুলি চালাতে বলি। কিন্তু উনি আমাকে পিস্তল ফিরিয়ে দেন।’’
২০১৯ সালে গনির নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার সময় তাঁর উপর হামলার পর স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের নামে উইল তৈরি করেন আমরুল্লা। তাতে তাঁর মৃত্যুর খবরের জন্য স্ত্রী-সন্তানদের প্রস্তুত থাকতে বলেন তিনি। আমরুল্লা বলেন, ‘‘আমি তালিবানের নিশানায় থাকব, সেটাই স্বাভাবিক। আমি তো পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের বলেই রেখেছি যে, আমার মৃত্যুতে যেন কেউ হা-হুতাশ না করে। কারণ ওদের অনেককে আমি নিজে হাতে নিকেশ করেছি। তার জন্য গর্ববোধ করি আমি।’’