নিয়োগ থেকে গরু পাচার— একাধিক দুর্নীতিকাণ্ডে রাজ্যের অনেক ওজনদার ব্যক্তি জেলবন্দি। সেই তালিকায় রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, তাঁর বান্ধবী, বিধায়ক, বড় নেতা, তাঁর কন্যা থেকে শুরু করে শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকে। অনেকের এ বারই প্রথম পুজো কাটবে জেলে। কারও কারও দ্বিতীয় বার। তাঁরা গত শারদীয়াও কাটিয়েছিলেন কারাগারে। আরও একটা পুজো এসে গেলেও তাঁদের জামিন হয়নি। বার বার খারিজ হয়েছে জামিনের আবেদন।
২০২২ সালের ২২ জুলাই সকালবেলা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে ঢুকেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির টিম। তার পর সারা দিন, সারা রাত জেরা, তল্লাশির পরে ২৩ তারিখ সকালে তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিবকে গ্রেফতার করে তারা। সেই থেকে ইডি ও তার পরে কিছু দিনের সিবিআই হেফাজতের পর পার্থ রয়েছেন প্রেসিডেন্সি জেলে। গত পুজোটাও তাঁর কেটেছিল এই জেলেই। এ বারও তাই। যে পার্থ ছিলেন কলকাতার অন্যতম বড় পুজো নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পৃষ্ঠপোষক, সেই ক্লাব থেকে তাঁর নামও কার্যত মুছে গিয়েছে।
পার্থের সঙ্গে একই সময়ে টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাট থেকে ইডি গ্রেফতার করেছিল তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ বান্ধবী’ হিসাবে পরিচিত অভিনেত্রী তথা মডেল অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। শুধু তো অর্পিতাকে গ্রেফতার করা নয়, তাঁর টালিগঞ্জ এবং বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া নগদ টাকার ছবি দেখে চমকে উঠেছিল গোটা রাজ্য। সেই অর্পিতারও এ বার জেলে দ্বিতীয় পুজো।
পার্থ-অর্পিতার গ্রেফতার হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পরেই নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান শান্তিপ্রসাদ সিন্হাকে। আদালতে যে কমিটিকে বার বার ‘দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড’ বলে চিহ্নিত করেছে ইডি, সিবিআই। গত বছর ১০ অগস্ট গ্রেফতার হয়েছিলেন শান্তিপ্রসাদ। ফলে গত বারের পুজো তাঁর কেটেছিল জেলে। এ বারও কারারুদ্ধ হয়েই কাটাতে হবে শারোদৎসব। শান্তিপ্রসাদের সঙ্গেই ওই কমিটির সদস্য কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক সরকারও গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁদেরও জেলে দ্বিতীয় পুজো।
গত বছর অগস্টে আরও একটি বড় গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছিল। গরু পাচার মামলার তদন্ত সূত্রে বোলপুরের বাড়ি থেকে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। ১১ অগস্ট। সে দিন আবার ছিল ভরা পুর্ণিমা। কেষ্ট মণ্ডলের ২০২২ সালের পুজো কেটেছিল কারাগারে। এ বারও তাঁর অন্যথা হচ্ছে না। চতুর্থীর দিনও তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে, কেষ্টর গত বারের পুজো কেটেছিল আসানসোল সংশোধনাগারে। বাংলার জেলে। এ বার তাঁর পুজো কাটবে দিল্লিতে, তিহাড় জেলে।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গত বছর সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হয়েছিলেন এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য। ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে সুবীরেশই একমাত্র, যিনি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য।
গত বছর পুজোর আগে আর কোনও ওজনদার গ্রেফতার হননি। কিন্তু পুজো মিটতেই, ১১ অক্টোবর, ২০২২ তারিখে গ্রেফতার হন মানিক ভট্টাচার্য। যিনি শুধু শিক্ষাবিদ ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি নদিয়ার পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়কও বটে। পুজোর ঠিক পরেই, গত বছর মানিক গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাই গত বছর তাঁর পুজো কেটেছিল জেলের বাইরে। বাড়িতে। কারাগারে দুর্গাপুজোযাপন তাঁর এ বারই প্রথম। তাঁর স্ত্রী-পুত্রকেও গ্রেফতার করেছিল তদন্তকারী সংস্থা। স্ত্রী জামিন পেয়ে গেলেও পুত্র শৌভিকের জামিন মেলেনি। সে দিক থেকে পিতা-পুত্র দু’জনেরই এ বারের পুজো কাটবে জেলে।
২০২২ সালে আর তেমন বড় গ্রেফতারির ঘটনা ছিল না। কিন্তু জানুয়ারি পড়তেই ‘কাজ’ শুরু করে দেয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তৎকালীন যুব তৃণমূলের অন্যতম নেতা কুন্তল ঘোষকে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দারা। কুন্তল গত বারও পুজোর আগে তাঁর বেড়ে ওঠার এলাকা হুগলির বলাগড়ে দুঃস্থদের মধ্যে শারদ উপহার বিতরণ করেছিলেন। এ বার তাঁরও শারদীয়া কাটতে চলেছে জেলে।
কুন্তলের নাম যিনি প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তিনি বারাসতের তাপস মণ্ডল। একাধিক বেসরকারি বিএড কলেজকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ। তিনি আবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সেই তাপস মণ্ডলকে ইডি গ্রেফতার করে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি। তাঁরও এ বার জেলে প্রথম পুজো।
মার্চের ১১ তারিখ গ্রেফতার হন হুগলি জেলা পরিষদের সদস্য তথা জেলার দাপুটে তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও বলাগড়ের ভূমিপুত্র। জেলার রাজনৈতিক মহলের অনেকে বলেন, কুন্তল ও শান্তনু ছিলেন হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘মানিকজোড়’।
নিয়োগ দুর্নীতিতে এর পর এপ্রিল মাসে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহার বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। জীবনের বাড়িতে সিবিআই হানা বাংলার রাজনীতিতে মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেই মনে করেন অনেকে। বাড়ির পাশের পুকুরে তাঁর মোবাইল ছুড়ে ফেলা, পুকুরের জল ছেঁচে সেই মোবাইল উদ্ধারে দুঁদে গোয়েন্দাদের নাস্তানাবুদ হওয়া— কার্যত থ্রিলার সিনেমার প্লট তৈরি করে হয়েছিল বড়ঞায়। শেষ পর্যন্ত জীবনকে গ্রেফতার করে সিবিআই। জেলে তাঁর এটাই প্রথম পুজো।
জীবনের গ্রেফতারির সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে গরু পাচার মামলায় ইডি গ্রেফতার করে অনুব্রত মণ্ডলের কন্যা সুকন্যাকে। দিল্লিতে তাঁকে ডেকেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। কিন্তু তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। গত বার বাবার গ্রেফতারির মনখারাপ নিয়ে বোলপুরের বাড়িতেই কাটিয়েছিলেন সুকন্যা। এ বার তিনিও জেলে। বাবার মতোই তিহাড়ে।
মে মাসের ৩০ তারিখ গ্রেফতার হন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু। যিনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের কর্মচারী ছিলেন। সুজয়কৃষ্ণ পঞ্চমীর দিনও হাসপাতালে রয়েছেন। চতুর্থীতে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন ইডি কর্তারা। আরও কিছু দিন তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে বলে জানা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুজয়কৃষ্ণের পুজো কাটবে হাসপাতালে। তবে কয়েদি হিসাবেই।