ভোট শেষ হলেও নয়া প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণের এখনও প্রায় দু’মাস বাকি। কিন্তু, তার আগেই ‘সুপার পাওয়ার’ দেশ জুড়ে পড়ে গিয়েছে হুলস্থূল! জমি-বাড়ি, সব ছেড়ে পালানোর উপক্রম করছেন বাসিন্দাদের একাংশ।
৫ নভেম্বর হয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পরের দিন, অর্থাৎ ৬ তারিখ ভোটের ফল ঘোষণা হলে দেখা যায় ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান প্রার্থীর কুর্সি দখলের খবর মিলতেই দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়।
সূত্রের খবর, ট্রাম্প বিদ্বেষীদের অধিকাংশই উত্তরের প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডাকে এর জন্য বেছে নিয়েছেন। সেখানে দ্রুত কী ভাবে পৌঁছনো যাবে, তা জানতে শুরু হয়েছে ইন্টারনেটে তথ্যানুসন্ধান।
এ ব্যাপারে বিশেষ একটি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করছেন দেশত্যাগে ইচ্ছুক ট্রাম্প-বিরোধীরা। তা হল, ‘কী ভাবে কানাডায় যাওয়া যাবে’ (হাউ টু মুভ টু কানাডা)। ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন গুগ্লে এই কথাটি লিখে তথ্যানুসন্ধান করছেন তাঁরা।
কানাডায় আশ্রয়ের খোঁজ করা আমেরিকানদের অধিকাংশই অভিবাসী বলে জানা গিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। আর সেই ভয়েই আগেভাগে তাঁরা দেশ ছাড়তে চাইছেন বলে জানা গিয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। তার পরেই রাজধানী ওয়াশিংটনের ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (হোয়াইট হাউস) পা পড়বে তাঁর। কুর্সিতে বসেই বিপুল সংখ্যায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি করেছে অটোয়া প্রশাসন। কারণ, আমেরিকা ছেড়ে লাখ লাখ অভিবাসী ও শরণার্থীর অবৈধ ভাবে কানাডায় ঢুকে পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট হয়ে অভিবাসীদের একাংশকে দেশছাড়া করেন ট্রাম্প।
ওই সময়ে ডোনাল্ডের কোপে পড়েন প্রশান্ত মহাসাগরের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দেশ হাইতির অভিবাসীরা। তাঁদের দ্রুত ঘরে ফেরার নির্দেশ দেন ট্রাম্প। এর পরই নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় হাজারে হাজারে হাইতিবাসী আমেরিকা ছেড়ে কানাডায় ঢুকতে শুরু করেন। যার একটা বড় অংশের বিরুদ্ধেই অবৈধ ভাবে সীমান্ত টপকানোর অভিযোগ ওঠে।
ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন গুগ্লের ট্রেন্ড অনুযায়ী, গত ৫ নভেম্বর ‘কী ভাবে কানাডা যাওয়া যাবে’র তথ্যানুসন্ধান এক লাফে ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ট্রাম্পের মূল প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির গড় হিসাবে চিহ্নিত রাজ্যগুলির অভিবাসীদের মধ্যে এই নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাড়াঘাঁটা করতে দেখা গিয়েছে।
সেই তালিকায় একেবারে শীর্ষে রয়েছে ওয়াশিংটন, ওরেগন ও ভারমন্ট। এ ছাড়া ‘কানাডায় যাওয়ার জন্য কী কী প্রয়োজন’ (মুভিং টু কানাডা রিকোয়ারমেন্টস) এবং ‘কী ভাবে আমেরিকা থেকে কানাডা যাওয়া যাবে’ (মুভিং টু কানাডা ফ্রম ইউএস) সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানও হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গুগ্ল ট্রেন্ড জানিয়েছে, ট্রাম্পের জয় যত নিশ্চিত হয়েছে ততই বেড়েছে এই ধরনের সার্চ। কখন কখনও এতে পাঁচ হাজার শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছে। আগামী আরও কয়েক দিন এই প্রবণতা বজায় থাকবে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন, ‘রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ’-এর (আরসিএমপি) সার্জেন্ট চার্লস পোয়ারিয়ার। তাঁর কথায়, ‘‘কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সীমান্তে কড়া নজর রেখেছি। ট্রাম্প যদি অভিবাসন নীতিতে বদল আনেন, তা হলে কানাডায় অবৈধ ও অনিয়মিত অনুপ্রবেশ বেড়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।’’
অন্য দিকে স্থায়ী অভিবাসীর সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর। তিনি একে ২১ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু তার মধ্যেই আমেরিকা থেকে অভিবাসীদের স্রোত তাঁর দেশে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে কানাডার স্থায়ী অভিবাসীর সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লাখ। যা কমিয়ে চার লাখের নীচে আনার পরিকল্পনা রয়েছে ট্রুডোর। যদিও এ ব্যাপারে তিনি কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এ ব্যাপারে ট্রুডো বলেছেন, ‘‘আমরা একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সদ্য করোনা অতিমারি কাটিয়ে উঠেছি। এই অবস্থায় শ্রমের চাহিদা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে যে ভারসাম্য থাকা উচিত, তা বজায় রাখা যায়নি।’’
এ বারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল অভিবাসী ও শরণার্থী। গত কয়েক বছর ধরেই তাঁদের বিরুদ্ধে আটলান্টিকের পারের দেশটিতে মৌলবাদ ও ধর্মীয় কট্টরপন্থা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছিল।
গত বছরের (২০২৩) অক্টোবরে ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হলে ওয়াশিংটন খোলাখুলি ভাবে ইহুদিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবাদে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন শুরু করে হামাস ও প্যালেস্তিনীয় সমর্থকেরা।
শুধু তাই নয়, ম্যাসাচুসেট্সের বোস্টনে ঐহিত্যশালী হার্ডার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ দেখান ইজ়রায়েল বিরোধীরা। সেখানে আমেরিকার পতাকা নামিয়ে দেয় তাঁরা। তোলা হয় প্যালেস্টাইনের ঝান্ডা।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচনী প্রচারে এই নিয়ে সরব হন ট্রাম্প। অভিবাসী ও শরণার্থীরা আমেরিকাবাসীর পোষ্য কুকুর-বিড়াল কেটে খাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। কুর্সিতে বসলে অভিবাসী ও শরণার্থীদের যে দেশত্যাগের দরজা দেখানো হবে, তা-ও স্পষ্ট করেন ডোনাল্ড।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আসন্ন ট্রাম্প জমানায় অভিবাসী নীতি কড়া হলে অটোয়া-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। যা বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।