নোটবন্দির সিদ্ধান্তে কোনও ভুল ছিল না, সোমবার জানিয়ে দিল শীর্ষ আদালত। পুরনো ১০০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে যে মামলাগুলি হয়েছিল, সোমবার তার রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন জানিয়েছে শীর্ষ আদালত।
শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ, কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা বিবেচনা করে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে পাল্টানো যায় না। নোটবাতিলের ক্ষমতা কেন্দ্রের রয়েছে। তাই কেন্দ্রের তরফে থেকে এই প্রস্তাব এসেছে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে এই ভাবে ভুল বলে ঘোষণা করা যায় না।
সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক কোনও সিদ্ধান্তকে পাল্টে দেওয়া যায় না। কেন্দ্র আরবিআইয়ের সঙ্গে ৬ মাস ধরে পরামর্শ করার পরই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় ঘোষণার সময় জানিয়েছে।
পাশাপাশি, পুরনো নোট বদলানোর জন্য মাত্র ৫২ দিন সময় দেওয়াকেও ‘অযৌক্তিক’ বলে দাবি করেন আবেদনকারীরা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, নোট বদলানোর জন্য সঠিক সময়ই দেওয়া হয়েছিল এবং কোনও ভাবেই তাকে অযৌক্তিক বলা যায় না।
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে জানিয়েছে, নোটবন্দির উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কি না, তা ‘প্রাসঙ্গিক নয়’। ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় পড়ে শোনানোর সময় বিচারপতি বিআর গাভাই বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে অত্যন্ত সংযমী থাকতে হবে। আদালত নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে এই ভাবে পাল্টে ফেলতে পারে না।’’
বিচারপতি আব্দুল নাজিরের নেতৃত্বে ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ শীতকালীন বিরতির আগে বাদী-বিবাদী পক্ষের যুক্তি শুনেছিল এবং ৭ ডিসেম্বর রায়দান স্থগিত রেখেছিল। সাংবিধানিক বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন, বিচারপতি বিআর গাভাই, বিভি নাগরত্না, এএস বোপান্না এবং ভি রামাসুব্রহ্মণ্যম।
সাংবিধানিক বেঞ্চের ৪ বিচারপতি কেন্দ্রের নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না বলে রায় দিলেও বিচারপতি নাগরত্না এই মামলায় পৃথক মত পোষণ করেন। বিচারপতি নাগরত্না এই সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
রায় ঘোষণা সোমবার হলেও কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত ৬ বছরের পুরনো। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে নতুন ৫০০ এবং ২০০০ টাকার নোট চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, কালো টাকার রমরমা রুখতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই সিদ্ধান্তের জেরে দেশের ৮৬ শতাংশই ব্যাঙ্কনোটই রাতারাতি বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছিল। ২০১৬ সালে ৬৮ শতাংশ লেনদেনই ব্যাঙ্কনোটের মাধ্যমে হত।
জাল টাকা, সন্ত্রাসে অর্থ জোগানো, কালো টাকার রমরমা এবং কর ফাঁকি রোখার একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলেও সেই সময় কেন্দ্র জানিয়েছিল।
সরকারের তরফে সেই আবহে দাবি করা হয়েছিল, পুরনো নোট বদল করলে কালো টাকা রাখা ব্যক্তিরা এক দিকে যেমন বিপদে পড়বে, তেমনই ভারতীয় অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে। কিন্তু নোটবন্দি হতেই সম্পূর্ণ অন্য এক চিত্র ধরা পড়ে।
কেন্দ্রের তরফে রাতারাতি নোটবন্দি করার সিদ্ধান্তে দেশ জুড়ে সমস্যার মুখে পড়েন সাধারণ মানুষ। সিদ্ধান্তের এক দিন পর থেকে ব্যাঙ্কের বাইরে নতুন টাকা পেতে ভিড় জমানো শুরু হয়।
পুরনো নোট বদলে ফেলার জন্য কেন্দ্রের তরফে ৫২ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাঙ্কের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাই বদলাতে পারবেন আমজনতা।
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি দেশে বিয়ের মরসুম। অর্থাৎ, প্রচুর টাকার লেনদেন। তাই সেই সময় সব থেকে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছিলেন বাড়িতে অনুষ্ঠান রয়েছে, এমন সাধারণ জনতা।
টাকা বদলানোর ভিড়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুও দেখেছিল দেশবাসী। আর সেই নিয়েও দেশ জুড়ে যথেষ্ট শোরগোল পড়েছিল। হাতে থাকা বাতিল টাকার ভার সামলাতে না পেরে সারা দেশে অনেক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার খবরও উঠে এসেছিল।
এ ছাড়া নতুন নোট নিয়ে একাধিক ভুয়ো তথ্যও ছড়িয়েছিল সমাজমাধ্যমে। একাংশের দাবি ছিল, নতুন নোটে নাকি এমন সব ট্র্যাকার লাগানো রয়েছে, যাতে নতুন নোট চুরি গেলে তা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। পরে অবশ্য সেই সব দাবি গুজব বলে প্রমাণিত হয়।
নোটবন্দির পর দেখা যায়, যত টাকা খোলা বাজারে ছিল, তার প্রায় পুরোটাই ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কে।
মোদী সরকারের নোটবন্দির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিরোধী দলগুলি। বিরোধী নেতাদের দাবি ছিল, সরকারের প্রতিশ্রুতি মতো কালো টাকার রমরমা একফোঁটাও কমেনি। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, নোটবন্দি সরকারের ব্যর্থতা এবং ভারতীয় ব্যবসা ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা।
নোটবন্দিকে চ্যালেঞ্জ করে এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অসংখ্য মামলা রুজু করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানো হয়েছিল। যদিও সে সময় এই মামলাগুলির জন্য কোনও সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠিত ছিল না। অবশেষে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ঘোষণার ৬ বছর পর মামলাগুলির শুনানি শুরু হয়।
নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ৫৮টি পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। আবেদনকারীদের যুক্তি, সরকার সঠিক পরিকল্পনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা উচিত। সরকারের পাল্টা যুক্তি ছিল, বাস্তবে এই সিদ্ধান্তকে বাতিল করা সম্ভব নয়। নোটবন্দির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হলে ‘সময়ের পিছনে গিয়ে’ বাতিল করতে হবে বলেও দাবি করেন কেন্দ্রের আইনজীবী।
কেন্দ্রের আইনজীবী আরও দাবি করেন, নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ‘সুবিবেচিত’ ছিল। জাল টাকা এবং কালো টাকার রমরমা-সহ একাধিক অর্থনৈতিক একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
অন্য দিকে, আবেদনকারীদের পক্ষে সওয়াল করে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং আইনজীবী পি চিদাম্বরম যুক্তি দিয়েছিলেন, কেন্দ্র জাল বা কালো টাকা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প পদ্ধতিগুলি পরীক্ষা করে না দেখেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।