২০১৩ সাল। দীর্ঘ সময় পাকিস্তানে বন্দি পঞ্জাবের ছেলে সর্বজিৎ সিংহ আটওয়ালকে ঘরে ফেরাতে তখন মরিয়া হয়ে লড়াই চালাচ্ছেন তাঁর দিদি দলবীর কউর। স্বামীকে দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন স্ত্রী সুখপ্রীত কউর। অপেক্ষায় ছিলেন দুই কন্যাও। তার মধ্যেই ওই বছরের ২৬ এপ্রিল খবর আসে লাহোরের কারাগারে অন্য কয়েদিদের হামলার মুখে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বজিৎ। কোমায় চলে গিয়েছেন তিনি।
এর পর টানা ছ’দিনের অপেক্ষা। ২০১৩ সালের ২ মে কোমায় থাকাকালীন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে পাকিস্তানের হাসপাতালেই মৃত্যু হয় সর্বজিতের। ভারতের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য তাঁকে ফেরত পাঠায়নি পাকিস্তান। সর্বজিতের মৃত্যুতে শোকে ভেঙে পড়েছিল গোটা দেশ।
পাক কারাগারে সর্বজিতের উপর হামলায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন গ্যাংস্টার আমির সরফরাজ় তাম্বা। রবিবার তাঁরও মৃত্যু হয়েছে। লাহোরে অজ্ঞাতপরিচয় এক আততায়ী সরফরাজ়কে লক্ষ্য করে গুলি করে বলে খবর।
পাক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম ছিল ডন সরফরাজ়ের। খুন, অপহরণ-সহ একাধিক অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সরফরাজ় জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সঈদের ‘ঘনিষ্ঠ’ সহযোগী ছিলেন বলে মনে করা হয়। অভিযোগ, ২০১৩ সালে তিনিই অন্য কয়েদিদের সঙ্গে নিয়ে লাহোরের জেলে সর্বজিতের উপর হামলা চালিয়েছিলেন।
সর্বজিতের জন্ম ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পঞ্জাবের তরণ তারণ জেলার ভিখিউইন্দ গ্রামে। স্ত্রী সুখপ্রীত এবং দুই কন্যা, স্বপ্নদীপ এবং পুনম কউরকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁর। দিদি দলবীরও তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন।
কৃষক পরিবারের ছেলে সর্বজিৎ এক দিন রাতে মত্ত অবস্থায় পথ ভুলে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। গ্রেফতার হন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে। বহু দিন তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রায় ন’মাস পর সর্বজিতের পরিবার জানতে পারে, মনজিৎ সিংহ নামে পাকিস্তানের জেলে বন্দি রয়েছেন তিনি।
১৯৯০ সালে পাকিস্তানের লাহোর এবং ফয়সলাবাদে পর পর বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। তাতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। সেই বিস্ফোরণকাণ্ডে সর্বজিতের নাম জড়িয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি এবং জঙ্গি কার্যকলাপের অভিযোগও এনেছিল পাকিস্তান সরকার।
সর্বজিতের পরিবার বার বার দাবি করে, কোনও ভাবেই তিনি বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত নন। ভারতের যুক্তি ছিল, বোমা হামলার অনেক পরে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন সর্বজিৎ। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি।
১৯৯১ সালে পাকিস্তানের আদালত সর্বজিৎকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায়। তাঁর মুক্তির জন্য লড়াই করে ভারত সরকার। ২০০৮ সালে পাক সরকার অনির্দিষ্ট কালের জন্য সর্বজিতের প্রাণদণ্ড মুলতুবি রাখে।
সর্বজিৎকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ১৯৯১ সাল থেকে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন দিদি দলবীর। লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন ২০১৩ সালে সর্বজিতের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। তবে ভাইকে বাড়ি ফেরাতে পারেননি।
১৯৯১ থেকে ২০১৩— ২২ বছর লাহোরের কোট লাখপত জেলে কাটিয়েছিলেন সর্বজিৎ। এর মাঝে বিস্ফোরণকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ধরা পড়ে। তবে পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পাননি সর্বজিৎ।
এর পর ২০১৩ সালের ২৬ এপ্রিল লাহোরের জেলে সর্বজিতের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ডন সরফরাজ়ের নেতৃত্বে এক দল কয়েদি ধারালো ধাতব পাত, লোহার রড, ইট এবং টিনের টুকরো দিয়ে হামলা চালান সর্বজিতের উপর।
মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন সর্বজিৎ। তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় লাহোরের জিন্না হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সর্বজিৎকে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সর্বজিৎ কোমায় চলে গিয়েছেন এবং তাঁর বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
সেই সময় দিদি দলবীর, স্ত্রী সুখপ্রীত এবং দুই কন্যাকে পাকিস্তানে গিয়ে সর্বজিৎকে দেখে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ২৯ এপ্রিল ভারত সরকার পাকিস্তানের কাছে মানবিক কারণে সর্বজিৎকে মুক্তি দেওয়ার এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে ফেরানোর আবেদন জানায়। কিন্তু পাকিস্তান সেই আবেদনেও সাড়া দেয়নি।
হামলার ছয় দিন পর, অর্থাৎ ২ মে হাসপাতালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় সর্বজিতের। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যু হয়েছিল সর্বজিতের। তাঁর খুলির উপরে একটি পাঁচ সেন্টিমিটার চওড়া আঘাতের চিহ্ন ছিল। পেটে, মুখে, ঘাড়ে এবং হাতেও আঘাতের দাগ ছিল।
এর পর একটি বিশেষ বিমানে সর্বজিতের দেহ ভারতে নিয়ে আসা হয়। ভারতীয় চিকিৎসকেরা অমৃতসরে দেহের ময়নাতদন্ত করে জানান, খুন করার উদ্দেশ্য নিয়েই হামলা চালানো হয়েছিল সর্বজিতের উপর।
ময়নাতদন্তে দেখা যায়, হৃদ্যন্ত্র, কিডনি-সহ বহু অঙ্গ সর্বজিতের শরীর থেকে গায়েব। ভারতীয় চিকিৎসকেরা মনে করেছিলেন, পাকিস্তানে প্রথম ময়নাতদন্তের সময় ওই অঙ্গগুলি শরীর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
সর্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পর এ বার অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে লাহোরে মৃত্যু হল সেই ঘটনার মূল অভিযুক্ত সরফরাজ়ের।