লোককথা এবং কিংবদন্তিতে মোড়া আমেরিকার এক জন বিখ্যাত সেনানায়ক ছিলেন ডেভি ক্রোকেট। লোককথা অনুযায়ী, তিনি আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম নায়ক এবং বীর যোদ্ধা। প্রচলিত আছে, ক্রোকেটের লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। তিনি নাকি কুঠার দিয়ে বন্দুকের গুলিকেও সহজে আটকে দিতেন। আমেরিকার সেনার কাছে তাঁর নামে তৈরি এমন এক অস্ত্র ছিল যার আঘাতে মুহুর্তে ধূলিস্মাৎ হতে পারত একটি গোটা শহর।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তৈরি সেই রকেট লঞ্চারের নাম ছিল ‘এম২৮/২৯ ডেভি ক্রোকেট ওয়েপন সিস্টেম’।
‘এম২৮/২৯ ডেভি ক্রোকেট ওয়েপন সিস্টেম’ ছিল একটি মানববাহী রকেট লঞ্চার। এই লঞ্চার ৩৪ কেজির পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র ডব্লু৫৪ প্রায় ৪ কিমি পর্যন্ত ছোড়ার ক্ষমতা রাখত।
তিন জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অনায়াসে এই গোটা রকেট লঞ্চার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিয়ে যেতে পারতেন।
মনে করা হয় ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে নেটো এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে বিপুল সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা হয়েছিল। এই পারমাণবিক অস্ত্রগুলি নাকি পৃথিবীর মতো ২০টি গ্রহকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
১৯৬৭ সাল নাগাদ আমেরিকাতে নাকি ৩১,২৫৫টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ ছিল। এর মধ্যে কয়েক হাজার শুধু কৌশলগত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যা সাধারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য রাখা ছিল।
এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে ছিল যেমন ১৫৫ মিলিমিটারের ডব্লু৪৮ পারমাণবিক আর্টিলারি মিসাইল।
১৯৫০-এর দশকে হেসে-থুরিংয়ান সীমান্ত এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যাম মেনের মধ্যে ফুলদা গ্যাপ নামে একটি জায়গায় ডেভি ক্রোকেট মিসাইলের ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
মনে করা হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই ফুলদা গ্যাপেই তার প্রথম ছাপ পড়বে। কূটনীতিকদের একাংশ এ-ও মনে করেছিলেন যে এই পথেই পশ্চিম জার্মানিতে হামলা চালাবে সোভিয়েট।
তবে ফুলদা গ্যাপে সোভিয়েটকে কোণঠাসা করে রাখতে আমেরিকার হাতে তৈরি ছিল ‘এম২৮/২৯ ডেভি ক্রোকেট ওয়েপন সিস্টেম’। পাশাপাশি রাখা ছিল কিছু পারমাণবিক ল্যান্ডমাইনও।
ডেভি ক্রোকেট মিসাইল দ্বারা ব্যবহৃত ডব্লু৫৪ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা বাকি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অনেক ছোট ছিল। এর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ০.০১-০.০২ কিলোটন, যা ১০ থেকে ২০ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমতুল্য। হিরোশিমায় যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল তার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১৫ কিলোটন যা ১৫ হাজার টন টিএনটির সমতুল্য।
বেশিরভাগ পরমাণু অস্ত্রের তুলনায় ছোট হলেও সোভিয়েটকে আটকাতে এটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন।
ডেভি ক্রোকেট মিসাইলের কয়েকটি বিস্ফোরণ একটি শহরকে মুহুর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত।
তবে এই অস্ত্রের বিকিরণ-ই ছিল আসলে প্রাণঘাতী। বিস্ফোরণের কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারত এই ক্ষেপণাস্ত্রের তৈরি হওয়া বিকিরণ।
তবে ডেভি ক্রোকেট মিসাইলের বেশ কয়েকটি সমস্যা ছিল। বেশির ভাগ সময়ই এই লঞ্চার থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ভুল লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হানত। প্রায়শই লক্ষ্য থেকে কয়েকশো ফুট দূরে গিয়ে আঘাত হানত ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি।
আর সেই কারণেই দ্রুত গতিসম্পন্ন ট্যাঙ্ক লক্ষ্য করে ছোড়া ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির একটিও কখনও কোনও ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া গাড়ি ধ্বংস করতে পারেনি।
পাশাপাশি মানবচালিত হওয়ার কারণে যারা এই রকেট লঞ্চার চালাতেন, তাদেরও ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল সমূহ। পাশাপাশি এই রকেট লঞ্চার ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট দূষণের মাত্রাও ছিল লাগাম ছা়ড়া।
অনেক দিক ভেবে ১৯৭১ সালে ‘এম২৮/২৯ ডেভি ক্রোকেট ওয়েপন সিস্টেম’-এর ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
পৃথিবীর একমাত্র মানবচালিত পারমাণবিক রকেট লঞ্চার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ডেভি ক্রোকেট-এর। কিন্তু কয়েকটি ক্রুটির কারণে তা হয়ে ওঠেনি।