এনডিএ-র শরিক দল লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস)-র বা এলজেপিআর নেতা চিরাগ পাসোয়ান পূর্ণমন্ত্রী হলেন তৃতীয় মোদী সরকারের। এই প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন চিরাগ। বিহারের হাজিপুর থেকে লোকসভা ভোটে জিতেছেন তিনি। চিরাগের নেতৃত্বে বিহারে মোট পাঁচটি লোকসভা আসনে জিতেছে এলজেপিআর। চিরাগ কথার অর্থ প্রদীপ।
হাজিপুর কেন্দ্র থেকে চিরাগ ছ’লক্ষেরও বেশি ভোটে জিতেছেন। আরজেডির প্রার্থীকে হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ ৭০ হাজার ভোটে।
প্রথম দিকে জাতীয় রাজনীতিতে বাবা রামবিলাসের মতো ততটাও সমাদৃত ছিলেন না চিরাগ। তবে নিজেই নিজের ভাগ্য পাল্টালেন। ললাটের লিখন আরও পোক্ত হল লোকসভা নির্বাচনে। বিহার তথা জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে উত্থান হল তাঁর। ২০২৪-এর লোকসভা চিরাগের রাজনৈতিক যাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
চিরাগ যে হাজিপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছেন, একদা সেই কেন্দ্র থেকেই আট বার লোকসভা নির্বাচন জিতেছেন তাঁর পিতা তথা বিহারের অন্যতম দলিত নেতা রামবিলাস পাসোয়ান।
তবে চিরাগের জীবনের শুরু রাজনীতি দিয়ে হয়নি, হয়েছিল সিনেমা জগতের হাত ধরে।
২০১১ সালে অভিনেত্রী তথা সাংসদ কঙ্গনা রানাউতের সঙ্গে জুটি বেঁধে ২০১১ সালে ‘মিলে না মিলে হাম’ নামে মুক্তি পাওয়া ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল চিরাগকে। যদিও ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, এর পর আর কোনও ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাননি চিরাগ। ‘ফ্লপ’ হিরোর তকমা জোটে তাঁর কপালে।
বছর তিনেকের প্রচেষ্টার পর বলিউডকে বিদায় জানিয়ে ঘরের ছেলে চিরাগ ঘরে ফিরে যান। রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করেন বাবার হাত ধরে।
রামবিলাসের পরামর্শে ২০১৪ সালে জামুই থেকে লোকসভা নির্বাচনে লড়েন চিরাগ। জিতেও যান। সুদর্শন এই যুবাকে নিয়ে ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়তে থাকে বিহারের রাজনীতিতে।
২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনেও জামুই কেন্দ্র থেকেই নির্বাচন লড়েন চিরাগ। আসন ধরে রাখতে সফল হন।
২০১৯ সালে এনডিএ-র শরিক হিসাবে ছ’টি আসনে লড়ে সব ক’টিতেই জিতেছিল সাবেক লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি)। তবে রামবিলাসের মৃত্যুর পর আড়াআড়ি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তাঁর দল এলজেপি।
২০২০ সালে রামবিলাসের মৃত্যুর পরে পরেই চিরাগ এবং তাঁর কাকা পশুপতির পারিবারিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরে।
রামবিলাসের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে চিরাগ এবং তাঁর কাকা পশুপতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে এনডিএ ছাড়েন চিরাগ। কিন্তু নিজের দল রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি (আরজেএলপি)-কে নিয়ে এনডিএ-তে থেকে যান পশুপতি।
চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ২০২০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চিরাগ। নীতীশ কুমারের জেডিইউ দলের আধিপত্য থাকা প্রত্যেকটি আসনে প্রার্থী দেয় এলজেপিআর।
ফলে ভোট কাটাকাটিতে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ২৭টি বিধানসভা আসন হাতছাড়া হয় নীতীশের দলের। এর পরে পরেই রাজনীতিবিদ তথা দলিত নেতা হিসাবে বিহারে চিরাগের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০২১-এর মধ্যপর্বে এলজেপির ভাঙনের সময় বিজেপি দাঁড়িয়েছিল তাঁর কাকা পশুপতি পারসের পাশে। সে সময় পশুপতি-সহ লোকসভায় দলের পাঁচ সাংসদ এক দিকে ছিলেন। অন্য দিকে একা চিরাগ।
সেই পরিস্থিতিতে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা পশুপতি গোষ্ঠীকেই ‘এলজেপি সংসদীয় দলের’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এনডিএ জোটে পশুপতি গোষ্ঠীকে স্থান দিয়েছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও চিরাগকে ব্রাত্য করে পশুপতিকে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন।
তবে রামবিলাসের যে দলিত ভোটব্যাঙ্ক, তা চিরাগের সঙ্গেই রয়েছে, এমন ইঙ্গিত পেয়েই তাঁকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে পদ্মশিবির। পশুপতিকে ব্রাত্য করে চিরাগকেই এলজেপি-র ভাগের আসন দেওয়া হয়। চিরাগও আনুষ্ঠানিক ভাবে এনডিএ-তে ফেরেন। অভিমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব এবং এনডিএ-দুইই ছাড়েন পশুপতি।
তবে প্রথম থেকেই লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন চিরাগ। ২০২১ সালে ‘আশীর্ব্বাদ যাত্রা’ নামে প্রচার মিছিলও শুরু করেছিলেন তিনি, যা বিহারে তাঁর সমর্থকদের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
চিরাগের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২৩ সালে তাঁকে স্বাগত জানায় বিজেপি। বিহারে লোকসভা নির্বাচনের জন্য আসন ভাগাভাগির আলোচনায় চিরাগের দল হাজিপুর-সহ বিহার লোকসভার পাঁচটি আসন সুরক্ষিত করে। পাশাপাশি জামুই ছেড়ে হাজিপুর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। পাঁচটি আসনেই জেতে এলজেপিআর। এর পরেই রবিবার মোদী ৩.০ সরকারের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেন চিরাগ।