ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত গাজ়া ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে শুক্রবার সকাল থেকে। মূলত কাতার, মিশর এবং আমেরিকার যৌথ মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ বিরতির চুক্তিতে রাজি হয়েছে প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র বাহিনী হামাস এবং ইজ়রায়েলি সেনা।
সরকারি ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়ায় টানা সপ্তম সপ্তাহ ধরে চলা সংঘাতে খানিক লাগাম পড়েছে। বন্ধ হয়েছে গোলাগুলি এবং বিস্ফোরণের কোলাহল।
ইজ়রায়েলের সরকার জানিয়েছে, চুক্তির শর্ত মোতাবেক হামাস ইজ়রায়েল থেকে অপহৃত ২৪০ জনের মধ্যে অন্তত ৫০ জনকে মুক্তি দেবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ১৩ জন মহিলা এবং শিশুকে। তবে তার বিনিময়ে ইজ়রায়েলের জেলে বন্দি ঠিক কত জন প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দেওয়া হবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।
ইজ়রায়েলের সরকারি আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, প্রতি এক জন বন্দির বিনিময়ে তিন জন প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দেওয়া হবে। চুক্তির পারিপার্শ্বিক শর্ত মেনে, গাজ়ায় যত দ্রুত সম্ভব মানবিক সাহায্য এবং ত্রাণ পাঠাতেও সাহায্য করবে ইজ়রায়েল। যদিও চুক্তির অনেক শর্তই এখনও পর্যন্ত অস্পষ্ট।
তবে যুদ্ধবিরতি শেষ হলেই আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে যুযুধান ইজ়রায়েলি সেনা এবং হামাস। আর যুদ্ধ শুরু হলে হামাসের বিরুদ্ধে ‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’ ব্যবহার করতে পারে ইজ়রায়েল।
দেশের আকাশকে নিরাপদ রাখতেই ইজ়রায়েল এই মহাশক্তিধর হাতিয়ার কাজে লাগাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, আকাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য হামাসের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে প্রথম বার এই অত্যাধুনিক লেজ়ার অস্ত্র ব্যবহার করতে চলেছে ইজ়রায়েল।
২০১৪ সালে ‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’ প্রথম প্রকাশ্যে আসে। ইজ়রায়েলকে শত্রু দেশের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল।
মনে করা হয়, অত্যাধুনিক সেই লেজ়ার অস্ত্র ‘স্টার ওয়ার্স’ এবং ‘স্টার ট্রেক’-এর মতো কল্পবিজ্ঞানের সিনেমার অস্ত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’ প্রথম সিঙ্গাপুরের একটি অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে আনা হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ এই অস্ত্র ইজ়রায়েলের সেনায় পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তাড়াহুড়ো করে আসরে নামানো হল ‘মহাস্ত্র’কে।
ইজ়রায়েলের আকাশকে সুরক্ষিত রাখতে সে দেশের সেনার হাতে আগে থেকেই ‘অ্যারো-২’, ‘অ্যারো-৩’, ‘ডেভিডস স্লিং’ এবং ‘আয়রন ডোম’-এর মতো ‘নিশ্ছিদ্র পাহারাদার’ রয়েছে। সেই তালিকাতেই নয়া সংযোজন হল ‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’, ‘আয়রন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার থেকে আরও বেশি আধুনিক এবং সাশ্রয়ী।
আয়রন ডোম থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তৈরিতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। সে জায়গায় লেজ়ার রশ্মি তৈরির খরচ মাত্র কয়েক ডলার।
আয়রন ডোমের চেয়ে হালকা এবং ছোট হওয়ার কারণে আয়রন বিম সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। লুকিয়ে ফেলাও সহজ।
‘আয়রন বিম লেজ়ার গান’ ইজ়রায়েলের পুরো আকাশকে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে ইজ়রায়েলের এই মহাস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আয়রন বিমের কিছু ত্রুটিও রয়েছে। এই অস্ত্র ভিজে গেলে তা সঠিক ভাবে কাজ না-ও করতে পারে। এমনকি স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াতে লেজ়ার রশ্মি লক্ষ্যে পৌঁছনোর আগেই সম্ভাব্য শক্তির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারাবে।
তবে যে আয়রন ডোমকে ইজ়রায়েলের ‘নিশ্ছিদ্র পাহারাদার’ বলে মনে করা হত, সেই প্রযুক্তিও হামাসের মুহুর্মুহু হামলায় কার্যত ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছিল।
ইজ়রায়েলের আকাশসীমায় কড়া নজরদারি চালায় আয়রন ডোম। রকেট হামলা হোক বা ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকি ড্রোন হামলা— কোনও কিছুই এর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। ইজ়রায়েলের মাটিতে হামলা করার আগেই সেই সব লক্ষ্যবস্তুকে আকাশে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
ভূমি থেকে আকাশ স্বল্প পাল্লার হামলা প্রতিরোধকারী এই আয়রন ডোম মূলত তিনটি কাজ করে। রাডারের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে পারে, দ্রুত সেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য তৎপর হতে পারে এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে রুখে দিতে পারে।
প্রতিনিয়ত আকাশ প্রতিরোধক এই ব্যবস্থাকে উন্নত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। তাদের আকাশসীমাকে আরও নিশ্ছিদ্র করতে আয়রন ডোমকে আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করা হয়েছে। ফলে আয়রন ডোমের নজরদারি এড়িয়ে আকাশপথে ইজ়রায়েলে হামলা চালানো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এ বার সেই ‘নিশ্ছিদ্র পাহারাদার’কেও একের পর এক রকেট হামলায় বিভ্রান্ত করে দিতে সক্ষম হয়েছে হামাস বাহিনী।
যে ‘আয়রন ডোম’কে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ হিসাবে মনে করা হয়, হামলা প্রতিরোধক যে অস্ত্রের জন্ম ইজ়রায়েলেই, সেই অস্ত্রই কেন হামাসের রকেট হামলাকে একেবারে রুখে দিতে পারল না?
বেশ কয়েকটি সূত্রের দাবি, অনেক দিন ধরেই ইজ়রায়েলের আয়রন ডোমের দুর্বলতা খোঁজার কাজ চালাচ্ছিল হামাস। সেই দুর্বলতা খুঁজেও বার করে ফেলে তারা। সে ক্ষেত্রে আয়রন বিমের দুর্বলতার খোঁজ পেয়ে গেলে, সেই অস্ত্রকেও যে অকার্যকর করা যাবে না, সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।