প্রথম দৃশ্য: ডিমের ওমলেট বানানো হবে বলে একের পর এক ডিম ফাটানো হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ রাঁধুনির হাতে এমন একখানা ডিম এসে পড়ে যে, তা কিছুতেই ফাটানো যাচ্ছে না। হাতুড়ি দিয়েও ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন রাঁধুনি। হাত থেকে ডিমটি পিছলে একটি কলসিতে লাগে। সেই আঘাতে ডিম না ভাঙলেও কলসিটি ফুটো হয়ে যায়। সন্দেহ হওয়ায় রাঁধুনিটি উপরের তাকে চেয়ে দেখেন, একটি মুরগি ফেভিকলের কৌটোয় রাখা দানা খাচ্ছে।
দ্বিতীয় দৃশ্য: নদীর ধারে বসে এক ব্যক্তি ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলেন। তাঁর পাশে হঠাৎ আর এক জন এসে বসলেন। কিন্তু তাঁর কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে যান প্রথম ব্যক্তি। একটি সরু কাঠিতে ফেভি কুইক লাগিয়ে তা জলের মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন দ্বিতীয় জন। সঙ্গে সঙ্গে কাঠির মধ্যে এসে জুড়ে পড়ল নদীর মাছ। পাশে যে ব্যক্তি ছিপ নিয়ে অনেক ক্ষণ মাছ ধরার অপেক্ষায় বসেছিলেন, তিনি থতমত খেয়ে যান। এই বিজ্ঞাপনগুলি দর্শকের আজও মনে রয়েছে। কিন্তু ফেভিকল, ফেভি কুইকের মতো পণ্য বিক্রয়কারী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা যিনি, তাঁর কেরিয়ারের পরতে পরতে ছিল বাধা। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন বলবন্ত পারেখ।
১৯২৫ সালে গুজরাতের ভাবনগর জেলার মাহুভা শহরে এক জৈন পরিবারে জন্ম বলবন্তের। তাঁর পুরো নাম বলবন্তরায় কল্যাণজি পারেখ। যদিও ‘ভারতের ফেভিকল ম্যান’ বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি।
ছোট থেকেই ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল বলবন্তের। কিন্তু পরিবারের সকলের ইচ্ছা ছিল, বলবন্ত আইন নিয়ে পড়াশোনা করে এগিয়ে যান।
বলবন্তের ঠাকুরদা ছিলেন দুঁদে আইনবিদ। বড় হয়ে যেন ঠাকুরদার মতো নাম করতে পারেন, তাই স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই বলবন্তের বাবা-মা তাঁকে মুম্বইয়ের একটি সরকারি কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন। পড়াশোনা চলাকালীন কান্তাবেন নামে এক মহিলাকে বিয়েও করেন বলবন্ত।
কিন্তু মুম্বইতে কিছুতেই মন টিকছিল না বলবন্তের। দেশ জুড়ে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন চলছিল সেই সময়। মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বলবন্ত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
মুম্বই ছেড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন বলবন্ত। কিন্তু বলবন্তের বাবা-মা জোর করে তাঁকে আবার মুম্বইয়ে পাঠান।
আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি অর্জন করেন বলবন্ত। কিন্তু দিনের পর দিন কালো কোট গায়ে চাপিয়ে সকলের সামনে মিথ্যা কথা বলতে ভাল লাগত না তাঁর। তাই তিনি বাড়ির অমতে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। বৌকে নিয়ে ঘর ছাড়েন তিনি।
বেকার অবস্থায় কী খাবেন, কোথায় থাকবেন কিছুই নিশ্চিত ছিল না বলবন্তের। মুম্বইয়ে এক বন্ধুকে বলে একটি গুদামঘরে স্ত্রী-সহ আশ্রয় নেন বলবন্ত। তার পর চাকরি খোঁজার চেষ্টা করতে থাকেন।
এক কাঠের ব্যবসায়ীর অধীনে নামমাত্র মাইনেতে পিওনের চাকরিতে ঢোকেন বলবন্ত। কিন্তু এই কাজেও মন টেকেনি তাঁর।
নিজের ব্যবসা শুরু করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বলবন্ত। পিওনের কাজে থাকাকালীন নিজে থেকেই যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করলেন তিনি। আমদানি-রপ্তানি কী ভাবে করা হয়, তা জানলেন।
সেই সূত্রে জার্মানিতেও গিয়েছিলেন বলবন্ত। ব্যবসা করতে গেলে নিজেকে কী ভাবে তৈরি করতে হয়, তা নিমেষে আয়ত্ত করে ফেলেন তিনি।
দেশ-বিদেশের নামকরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বলবন্তের। বিদেশ থেকে পেপার-ডাই আমদানি করে ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে শুরু করলেন তিনি।
এই ব্যবসা লাভের মুখ দেখার কয়েক মাসের মধ্যেই মুম্বইয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনে ফেলেন বলবন্ত। স্ত্রী, পুত্র এবং ভাইয়ের সঙ্গে সেখানেই থাকতে শুরু করেন তিনি।
কর্মসূত্রে একটি জার্মান সংস্থার সঙ্গে জড়িয়েছিলেন বলবন্ত। কিন্তু কারও অধীনে থেকে ব্যবসা করবেন না বলে নিজের সংস্থা খুলে ফেলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ভাই সুশীলের সঙ্গে মুম্বইয়ের জেকব সার্কেলে ‘পারেখ ডাইকেম ইন্ডাস্ট্রিজ়’ গড়ে তোলেন বলবন্ত। মূলত কাপড় রং করার জিনিসপত্র তৈরি করত তাঁর সংস্থা।
১৯৫৯ সালে পিডিলাইট সংস্থার জন্ম হয়। একটি ছোট দোকানে আঠা বিক্রি করা শুরু করেন বলবন্ত। সেই আঠার মান এত ভাল ছিল যে কাঠমিস্ত্রিরা শুধু ‘ফেভিকল’ কিনতেন। ভারতের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে ফেভিকল। তার পর ধীরে ধীরে পিডিলাইট সংস্থা ‘ফেভি কুইক’, ‘এম সিল’ নামের আরও দু’টি পণ্য তৈরি করা শুরু করে।
২০০৬ সালের মধ্যে পিডিলাইট সংস্থা ভারত ছাড়াও তাইল্যান্ড, আমেরিকা, দুবাই, মিশর এবং বাংলাদেশে নিজেদের কারখানা গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুরে একটি গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করা হয়।
ফেভিকলের ‘জোড়’ এতটাই মজবুত যে ৬৩ বছর ধরে ভারতবাসীর মনে রয়ে গিয়েছে এটি। আজও একচেটিয়া ব্যবসা করে চলেছে পিডিলাইট সংস্থা। ২০০-র বেশি পণ্য উৎপাদন করছে পিডিলাইট।
ব্যবসায় সফল বলবন্ত সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গুজরাতের সাহিত্য পরিষদ-সহ ভাবনগরের ‘সায়েন্স সিটি’ প্রকল্পেও প্রচুর অর্থ দান করেছেন তিনি।
ধীরুভাই অম্বানীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বলবন্তের। এমনকি দু’জনেই মুম্বইয়ে একই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে থাকতেন। ২০১৩ সালে ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন বলবন্ত। তবে তাঁর সংস্থার সঙ্গে এখনও তাঁর নাম জুড়ে। এ-ও আসলে ‘ফেবিকলেরই জোড়’।