Hambantota International Port

বদলে দেয় ভারত-শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক! চিনের চরবৃত্তি রুখতে হামবানটোটা নিয়ে আপত্তি ছিল দিল্লির

কলম্বোর পরে ভারত মহাসাগর দিয়ে ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর হাম্বানটোটা। ২০১০ সালে এই বন্দর চালু হয়েছিল। এই বন্দরের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব নিয়ে চর্চা তখন শুরু হয়, যখন চিন এই বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ০৮:১৫
Share:
০১ ২৪

হামবানটোটা আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর। কলম্বোর পরে এটিই ভারত মহাসাগর দিয়ে ঘেরা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর। ২০১০ সালে এই বন্দর চালু হয়েছিল। এই বন্দরের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব নিয়ে চর্চা তখন শুরু হয়, যখন চিন এই বন্দরকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ় নেয়।

০২ ২৪

প্রতি বছর আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে নোঙর ফেলে দেশ-বিদেশের বহু জাহাজ। শুধু ২০২০ সালেই এই বন্দরের মাধ্যমে ১৮ লক্ষ টন পণ্য আদানপ্রদান হয়েছে।

Advertisement
০৩ ২৪

শ্রীলঙ্কা অবস্থিত মলাক্কা প্রণালী এবং সুয়েজ খাল সংযোগকারী সমুদ্রপথের উপর। আনুমানিক ৩৬ হাজার জাহাজ এবং সাড়ে চার হাজার তেলের ট্যাঙ্কার প্রতি বছর এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। তাই এশিয়া এবং ইউরোপের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার গুরুত্ব অপরিসীম বলে মনে করা হয়।

০৪ ২৪

হামবানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দর তৈরির আগে শ্রীলঙ্কার একমাত্র প্রধান বন্দর ছিল কলম্বো। কলম্বো দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজের চাপ সামলে এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলম্বো বন্দরের উপর তৈরি হওয়া লাগামছাড়া চাপ কমাতে হামবানটোটা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা।

০৫ ২৪

সামুদ্রিক বাণিজ্যপথে যাতায়াতের সময় জাহাজে তেল ভরা, রক্ষণাবেক্ষণ, জিনিসপত্র কেনা এবং চিকিৎসা সরবরাহ সংগ্রহের জন্য এই বন্দর তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় শ্রীলঙ্কা সরকার।

০৬ ২৪

হামবানটোটার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে। শেষ হয় ২০১০ সালে। ২০১৬ সালে, এই বন্দর ১৮ লক্ষ ডলারের বাণিজ্য করেছিল। কিন্তু তার পরেও শ্রীলঙ্কার এই বন্দর অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক নয় বলে ঘোষণা করা হয়।

০৭ ২৪

এর পরই শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রনিল বিক্রমাসিঙ্ঘের সরকার দেশের অর্থনৈতিক ভান্ডারে বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধি করার তাগিদে এই বন্দর বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। চিনের এক সংস্থাকে ১১২ কোটি ডলারের বিনিময়ে বন্দরটি লিজ় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শ্রীলঙ্কা। পাশাপাশি চুক্তি করা হয়, বন্দরটিকে ঢেলে সাজাতে এবং অত্যাধুনিক বানাতেও বিনিয়োগ করবে ওই চিনা সংস্থা।

০৮ ২৪

২০১৭ সালের জুলাই মাসে চিনের ওই সংস্থা এবং শ্রীলঙ্কা সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বন্দরের ৭০ শতাংশ অংশীদারও করা হয় চিনের ওই সংস্থাকে।

০৯ ২৪

বন্দরলাগোয়া এলাকায় শিল্পতালুকও গড়ার পরিকল্পনা করে চিন। তার জন্য শ্রীলঙ্কা সরকার চিনের ওই সংস্থার হাতে ১৫ হাজার একর জমি তুলে দিয়েছিল।

১০ ২৪

শ্রীলঙ্কার বন্দরে চিনের বিনিয়োগ দেখেই টনক নড়ে আন্তর্জাতিক মহলের। কেন অর্থনেতিক সঙ্কটের মুখে থাকা শ্রীলঙ্কার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এই বন্দরের দায়িত্ব নিল চিন? উঠতে শুরু করে সেই প্রশ্নও।

১১ ২৪

চিনের এই ‘উদার’ মনোভাবে সন্দেহ তৈরি করেছিল ভারতের মনে। হামবানটোটা বন্দরের দায়িত্ব চিন নেওয়ার এই খবর দিল্লির জন্য ভাল নয় বলে সতর্ক করেছিলেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

১২ ২৪

হামবানটোটার চিনা শিল্পতালুক নিয়ে ভারতের কোনও বক্তব্য ছিল না। কিন্তু ওই বন্দরের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চিনের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল দিল্লি। হামবানটোটা বন্দরে চিন শক্তপোক্ত নৌঘাঁটি গড়ে তুলে ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলার কৌশল নিতে চায় বলেও মনে করে ভারত। আর তার জেরেই ভারত আপত্তি করে।

১৩ ২৪

এর পর চিনের তরফে শ্রীলঙ্কার নৌসেনাকে একটি যুদ্ধজাহাজ উপহার দেওয়ার নিয়ে কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর তা ভারতের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়িয়ে দেয়।

১৪ ২৪

জল্পনা ওঠে, ভারতের উপর নজরদারি চালাতে এবং গুপ্তচরবৃত্তি বৃদ্ধি করতে হামবানটোটার দায়িত্ব নিয়েছে চিন। তবে হামবানটোটার বাণিজ্যিক তাৎপর্যের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করে ভারতের অভিযোগকে ভ্রান্ত বলে দাবি করে বেজিং।

১৫ ২৪

চিনের যুক্তি ছিল, হামবানটোটা বন্দরটি শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ দিকে রয়েছে। তাই সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে এই বন্দরের কোনও বিকল্প হতে পারে না। আর সেই কারণেই এই বন্দর লিজ় নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে চিন।

১৬ ২৪

কলম্বোও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করে, কেবলমাত্র বাণিজ্যের খাতিরেই এই বন্দর লিজ় দেওয়া হয়েছে। বন্দরটি ‘একবিংশ শতাব্দীর মেরিটাইম সিল্ক রোড’-এর অংশ হয়ে উঠবে বলেও যুক্তি দেওয়া হয়।

১৭ ২৪

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদ সামান কেলেগামার মতে, শ্রীলঙ্কা সরকার প্রাথমিক ভাবে ভারতকে এই বন্দর প্রকল্প নির্মাণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু কৌশলগত কারণে বন্দর নির্মাণে বিলম্ব হতে পারে মনে করে শেষ পর্যন্ত চিনের সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে শ্রীলঙ্কা।

১৮ ২৪

তবে পরে শ্রীলঙ্কা স্পষ্ট করে জানায়, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কাজেই বন্দরকে ব্যবহার করতে পারবে চিন। হামবানটোটা বন্দরে কোনও রকম সামরিক কার্যকলাপ চালানোর অনুমতি চিনকে দেবে না শ্রীলঙ্কা। ভারতের আপত্তি রয়েছে বলেই চিনকে এই অনুমতি দেওয়া হবে না, এমনটাই জানান শ্রীলঙ্কার কূটনীতিকরা।

১৯ ২৪

কিন্তু এই যুক্তি মানতে রাজি হয়নি দিল্লি। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের মতে, চিনের স্বার্থে হাত পড়লে তারা হামবানটোটায় নৌসেনা মোতায়েন করতেই পারে। এই বন্দর চিনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান করিডর’ প্রকল্পেরই অঙ্গ। গোড়া থেকেই যে প্রকল্পের বিরোধিতা করছে ভারত। ভারতকে চারদিক থেকে ঘিরতে বেজিংয়ের কাছে শ্রীলঙ্কার এই বন্দর বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বলেও দাবি করে নয়াদিল্লি। চিনের সঙ্গে চুক্তির কারণে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের সমীকরণেও চিড় ধরে।

২০ ২৪

এর মধ্যেই ২০২২ সালে হামবানটোটা নিয়ে আবার জলঘোলা শুরু হয়। অগস্টের শুরুতেই সেই বন্দরে চিনের উপগ্রহ এবং ক্ষেপণাস্ত্র নজরদারি জাহাজ ‘ইউয়ান ওয়াং ৫’ নোঙর করার জন্য শ্রীলঙ্কার কাছে অনুমতি চায় চিন।

২১ ২৪

শ্রীলঙ্কা প্রশাসন জানায়, তারা চিনা জাহাজকে হামবানটোটা বন্দরে ঠাঁই দেওয়া হবে না। এই নিয়ে একপ্রস্ত জলঘোলা হয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশ তখন বলেছিলেন, ভারতের চাপের মুখেই চিনা নজরদার জাহাজটিকে তাদের বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিতে চাইছে না শ্রীলঙ্কা। পরে অবশ্য শ্রীলঙ্কার তরফে এই বিষয়ে অনুমতি দেওয়া হয়। ১৬ অগস্ট হামবানটোটা বন্দরে ঢোকে ইউয়ান ওয়াং ৫।

২২ ২৪

ভারতের তরফে চিনের এই নজরদার জাহাজের বিষয়ে ঘরোয়া ভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ভারতের আশঙ্কা ছিল, চিন এই জাহাজের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্পর্শকাতর তথ্য, উপগ্রহের অবস্থান ইত্যাদি জেনে যেতে পারে। চিন অবশ্য আশ্বস্ত করে জানিয়েছিল, তেমন কোনও উদ্দেশ্য তাদের নেই।

২৩ ২৪

তবে এর পর থেকে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারও প্রায় শূন্য। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে চিনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছে। চিনের ঋণের জালেই দ্বীপরাষ্ট্রটি অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে বলে মনে করেন সে দেশের বাসিন্দারাই। তাই শ্রীলঙ্কায় চিনের প্রভাব নিয়ে বহু বার ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গিয়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষকে।

২৪ ২৪

শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ভাবে দুঃস্থ হয়ে যাওয়ার পর সে দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। ফলে শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের সম্পর্ক এখন অনেকটাই পোক্ত বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদরা। সম্পর্কের সাময়িক শীতলতা কাটিয়ে উষ্ণ হয়েছে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক। এই সম্পর্ক হাম্বানটোটা তথা সারা শ্রীলঙ্কার উপর চিনের প্রভাব কমাতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement