শুক্রবার রাতে রাশিয়ার রক ব্যান্ড ‘পিকনিক’-এর একটি কনসার্টের জন্য প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিলেন মস্কোর ক্রকাস সিটি হলে।
২০০৯ সালে তৈরি হওয়া সেই ঝলমলে হলে বহু নামীদামি শিল্পীকে অনুষ্ঠান করতে দেখেছে মস্কো।
তেমনই শুক্রবারও রাশিয়ার ওই জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের গান শোনার জন্য উৎসুক শ্রোতাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
ক্রকাস সিটি হলে প্রায় সাত হাজার দর্শকের বসার বন্দোবস্ত রয়েছে। শুক্রবার অত দর্শক না হলেও খুব কমও ছিল না।
গিটারের তারে টান দিয়ে এবং গলা মিলিয়ে সঠিক সময়েই গান গাওয়া শুরু করেছিলেন ‘পিকনিক’-এর সদস্যেরা। হঠাৎই বিকট আওয়াজ। গান থামিয়ে দেয় ব্যান্ড। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান শ্রোতারা।
কিছু ক্ষণেই কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো কনসার্ট হল। খসে পড়ে ছাদের একাংশ। বাইরে গুলির আওয়াজও শুনতে পাওয়া যায়। তত ক্ষণে গান শুনতে আসা শ্রোতারা বিপদের আন্দাজ করে ফেলেছিলেন। পড়িমড়ি দৌড়তে শুরু করেন। অনেকে বাইরে বেরিয়ে যান। অনেকে আটকেও পড়েন।
কনসার্ট হলে হামলা চালানো জনা পাঁচেক বন্দুকবাজ তত ক্ষণে দর্শকদের লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সে দেশের এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত চলা সেই হামলা থেকে বাঁচতে অনেকেই মাটিতে শুয়ে পড়েছিলেন। গুলি চালানো বন্ধ হলে লোকজন সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন।
রাশিয়ার আপৎকালীন মন্ত্রক তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছে, হামলার হাত থেকে বাঁচতে হলের বেসমেন্টে প্রায় ১০০ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। হলের ভাঙা ছাদেও আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেকে।
হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ এবং অ্যাম্বুল্যান্স। শুরু হয় উদ্ধারকাজ। মৃতদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। যাঁরা অক্ষত ছিলেন, তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ‘পিকনিক’ ব্যান্ডের সদস্যদেরও।
সেই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা শতাধিক। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের অবস্থা সঙ্কটজনক বলেও রাশিয়ার একাধিক সংবামাধ্যম জানিয়েছে।
মস্কোর কনসার্ট হলে ওই হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে নিষিদ্ধ সেই জঙ্গিগোষ্ঠী রাশিয়ার রাজধানীতে হামলা চালানোর কথা মেনে নিয়েছে বলে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও মস্কোর এক থিয়েটার হলে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ২০০২ সালে মস্কোর দুব্রোভকা থিয়েটার হলে কনসার্ট চলাকালীন হামলা চালায় চেচেন জঙ্গিরা। ওই ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ১৭২ জন। রুশ কমান্ডোদের প্রত্যাঘাতে খতম হয় জঙ্গিরাও।
তবে ক্রকাস সিটি হলে এই ধরনের হামলার নজির অতীতে নেই। প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অনুষ্ঠানের আসন বসে ওই প্রেক্ষাগৃহে। গান শুনিয়ে যান নামী শিল্পীরা।
ক্রাসনোগর্স্ক জেলার ক্রকাস শহরে মস্কো রিং রোডের কাছেই রয়েছে ক্রকাস সিটি মল। সেই মলেরই লাগোয়া প্রেক্ষাগৃহ।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর ব্যবসায়ী আরাস আগালারভ এই মল এবং প্রেক্ষাগৃহের তৈরি করেন।
প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি ওই চত্বরে রয়েছে ক্রোকাস এক্সপো, ভেগাস সিটি হল-সহ একাধিক নামী হোটেল এবং রেস্তোরাঁ।
অতীতে এরিক ক্ল্যাপটন এবং জো ককারের মতো গায়ক ওই কনসার্ট হলে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। গান গেয়ে গিয়েছে অনেক নামী ব্যান্ড। রাশিয়ার অনেক নামী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও হয়েছে সেখানে।
২০১৩ সালে বিশ্বমানের এক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল ওই প্রেক্ষাগৃহে। সেই হলেই শুক্র-রাতে হামলা চালায় আইএস জঙ্গিরা।
অনেকে মনে করছেন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং জনবহুল হওয়ার কারণেই হামলার জন্য ওই প্রেক্ষাগৃহকে বেছে নিয়েছে আইএস জঙ্গিরা। পাশাপাশি, ওই হলে একসঙ্গে অনেক দর্শক বসতে পারেন। তাই নাশকতা ছড়ানোর জন্য ওই হলকে জঙ্গিরা বেছে নিয়েছে বলেও মত অনেকের।
২০১৫ সালে প্যারিসের ব্যাটাক্লান কনসার্ট হলের সঙ্গেও ক্রকাস সিটি হলের হামলার মিল খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।
মস্কোর হামলার ঘটনায় টাস্ক ফোর্স গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে সে দেশের পুলিশ। রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই হামলাকে জঙ্গিহানা বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই এই জঘন্য অপরাধের নিন্দা করা উচিত।”
মস্কোয় আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলার নিন্দা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শনিবার ‘এক্স (সাবেক টুইটার)’ হ্যান্ডলে পোস্ট করে মোদী লেখেন, ‘‘আমরা মস্কোয় জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করছি। নিহতদের পরিবারের জন্য আমরা প্রার্থনা করছি। এই শোকের সময়ে রাশিয়ার সরকার এবং জনগণের পাশে রয়েছে ভারত।’’ এই হামলার নিন্দা করেছে আমেরিকাও। তবে তারা এ-ও জানিয়েছে, এই হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের কোনও প্রকার যোগ নেই।