কাতার বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচের বাঁশি বাজার আগেই শুরু হচ্ছে ‘খেলা’! এবং তা শুরু হচ্ছে রেফারির কব্জিতে বাঁধা বিশেষ ঘড়িতে। বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচে মাঠে নামার ঠিক ১৫ মিনিট আগে যার শুরু। সে ‘খেলা’ শেষ হচ্ছে ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে।
লিয়োনেল মেসি, নেমারদের মতো না হলেও চলতি বিশ্বকাপে এই বিশেষ ঘড়ি নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে না। সুইৎজ়ারল্যান্ডের উব্লো ঘড়ি পরে মাঠে নামছেন ম্যাচ রেফারিরা।
ম্যাচ রেফারিরাই যে শুধু এ ঘড়ি পরছেন, তা নয়। এ বারের বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচের ১২৯ জন অফিশিয়াল, ৩৬ জন রেফারি, ৬৯ জন সরকারি রেফারি এবং ২৪ জন ভিডিয়ো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভার)-কে হাতে বাঁধতে দেওয়া হয়েছে উব্লো।
বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে ১৪ অক্টোবর উব্লো ঘড়ির ১ হাজার বিশেষ সংস্করণ ‘বিগ ব্যাং ই’ বাজারে ছেড়েছে সুইস সংস্থাটি। বিলাসবহুল ঘড়ি তৈরিতে দীর্ঘ দিন ধরেই রোলেক্স, রাডো বা ওমেগার ব্র্যান্ডের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে উব্লো। তবে কাতার বিশ্বকাপের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে এটি।
কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এ ঘড়িতে? ৫,৮০০ ডলারের (ভারতীয় মুদ্রায় দাম প্রায় ৪ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা) এ ঘড়িতে বন্দি ম্যাচের যাবতীয় খুঁটিনাটি। মাঠে নামার ঠিক ১৫ মিনিট আগেই ম্যাচের দু’পক্ষের প্রথম একাদশের ফুটবলারদের সমস্ত তথ্য পেয়ে যান রেফারিরা।
মাঠে নেমে খেলা শুরুর বাঁশি বাজানোর সময় থেকে অতিরিক্ত সময়ের যাবতীয় তথ্যই নিজের ভিতরে পুরে নেয় উব্লো ‘বিগ ব্যাং ই’।
উব্লোর ডায়ালটি একটি স্কেল দিয়ে ৫ ভাগে ভাগ করা। তাতে ম্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয়ার্ধ, প্রতি অর্ধের অতিরিক্ত সময় এবং ম্যাচের বিরতির সময়— এই ৫টি ভাগের যাবতীয় তথ্য জমা করতে থাকে এই ঘড়িটি।
বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে ক’টা হলুদ কার্ড দেখানো হল, কার কপালে লাল কার্ডের কোপ পড়ল? ক’টা পেনাল্টি পেল কোন দল? তেকাঠিতেই বা ক’বার বল ঠেলা হয়েছে? এ সব তথ্য নিজের কাছে জমা করতে থাকে উব্লো। এমনকি, গোলের বাইরের জালে বল মারলেও তা জেনে যায় এ ঘড়ি। যার সময়, সংখ্যা হিসাব রেখে দেয় নিজের ভিতরে। প্রয়োজনে পরেও এই সবিস্তার তথ্য ঘড়ি থেকে পেয়ে যান রেফারিরা।
গোলদাতা থেকে ম্যাচের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য দেখানোর জন্য অ্যানিমেশনের সাহায্য নিয়েছেন উব্লো প্রস্তুতকারকেরা। ডায়ালের স্কেলের উপর একটি ফুটবলের প্রতীক দিয়ে ম্যাচের বিভিন্ন কীর্তি বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়।
হলুদ বা লাল কার্ড দেখানো হলে বা প্রতিটি পেনাল্টি অথবা গোল হলে গোলদাতার নামও একই ভাবে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে দেখাতে থাকে ঘড়িটি।
কোনও ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ালে এই ঘড়িটি ‘একস্ট্রা টাইম মোড’-এ চলে যায়। আবার নক আউট পর্বে পেনাল্টিতে খেলার নিষ্পত্তি হলে তা ‘শুটআউট মোড’-এ চলে যাবে। প্রতিটি পেনাল্টির ফলাফল সবুজ বা লাল রঙের মাধ্যমে ঘড়িতে দেখানো হবে।
বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলার শেষে উব্লোর ‘ম্যাচ পিরি়য়ড অ্যানিমেশন’ ঘোষণা করে, এ বার খেলা সাঙ্গ! সে সময় ম্যাচের ফলাফলও ফুটে ওঠে ঘড়ির ডায়ালে।
এত কিছু তথ্যপ্রমাণ রাখার জন্য উব্লোর মাথায় পুরে দেওয়া হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষমতা। গুগ্ল অয়্যার অপারেটিং সিস্টেম (ওএস)-এর কোয়াডকম স্ন্যাপড্রাগন ৪১০০ প্রসেসর চালিত এই ঘড়িতে রয়েছে একটি অ্যাক্সেলোমিটার, একটি জাইরোস্কোপ, স্পিকার, জিপিএস এবং অবশ্য রেফারির হৃদ্স্পদন নজরের রাখার বন্দোবস্ত। এটিতে আগে থেকেই যোগ করা থাকে কয়েকটি প্রয়োজনীয় অ্যাপ।
উব্লো প্রস্তুতকারকদের দাবি, ২ ঘণ্টার চার্জে ঘড়ির পুরো ব্যাটারিই দিনভর কার্যক্ষম থাকবে। ৪৪ মিলিমিটারের ‘বিগ ব্যাং ই’-র ডায়ালটি বার্গেন্ডি রঙের। তবে এর স্ট্র্যাপটি কালো এবং বার্গেন্ডি মেশানো রাবারের। তাতে আবার কাতারের পতাকার রঙের ছোঁয়া। তবে রেফারিরা চাইলে কাতার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী যে কোনও দেশের পতাকার রংওয়ালা স্ট্র্যাপের উব্লো পরতে পারেন।
কবে থেকে বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল উব্লো? ২০০৮ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপের সরকারি ঘড়ি হিসাবে ময়দানে নেমেছিল উব্লো। এর দু’বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ফুটবল বিশ্বকাপে প্রথম বার একে প্রতিযোগিতার সরকারি ঘড়ি হিসাবে ঘোষণা করে ফিফা। তার পর থেকে টানা চতুর্থ বারের বিশ্বকাপে উব্লোই ভরসা রেফারিদের।
বিশ্বকাপ ছাড়াও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের মতো প্রতিযোগিতায় রেফারিদের হাতে উঠেছে একমাত্র উব্লো ঘড়ি।
উব্লোর যাত্রা অবশ্য সাম্প্রতিক নয়। ১৮৮০ সালের এই সংস্থাটি গড়ে তুলেছিলেন ইটালীয় শিল্পপতি কার্লো ক্রোকো। তবে এর উত্থান ঘটেছিল লাক্সেমবার্গ-সুইৎজ়ারল্যান্ডের ঘড়ি নির্মাতা তথা মার্কেটিংয়ের নামজাদা ব্যক্তিত্ব জঁ ক্লদ বিভারের হাত ধরে।
উব্লোর ঘড়ির ভোলবদলের পিছনে জঁ ক্লদের কৃতিত্ব প্রাপ্য বলে মনে করা হয়। ‘বিগ ব্যাং’ সংস্করণের ডায়ালে সময় মাপার কাঁটা-সহ সূক্ষ্ম কারুকাজ ভরে উব্লোর চেহারা পাল্টে দেন তিনি। ফুটবলের ময়দানে একটি বিলাসবহুল ঘড়ির বৈদ্যুতিন সংস্করণকে যুক্ত করার পিছনেও জঁ ক্লদের মাথাই রয়েছে।
উব্লো ‘বিগ ব্যাং ই’ স্মার্টওয়াচটি তৈরির সময় ফ্রান্সের মহিলা রেফারি স্টেফানি ফ্রাপার সাহায্যও নেওয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গত, প্রথম মহিলা রেফারি হিসাবে জার্মানি-কোস্টা রিকা ম্যাচ খেলিয়ে নজির গড়ে ফেলেছেন তিনি।
ঘড়িটি নিখুঁত করার পাশাপাশি এটি ব্যবহারে রেফারিদের যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয়, সে জন্য উব্লোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ফ্রাপা।
চলতি বিশ্বকাপ ছাড়াও জুভেন্তাস, চেলসি, আয়াখস এবং বেনফিকার মতো খ্যাতনামা ক্লাবগুলির ম্যাচেও উব্লোই সরকারি ঘড়ির তকমা পায়।
বিশ্বকাপ চলকালীন উব্লোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে পুরুষ ফুটবলারদের মধ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে। পেলে, লুই ফিগো, দিদিয়ের দেঁশ, মার্সেল দেসাইয়ের মতো প্রাক্তন এবং কিলিয়ান এমবাপের মতো বর্তমান তারকাকে। এই তালিকায় রয়েছেন রোমার ম্যানেজার হোসে মোরিনহো। তবে মহিলা ফুটবলারদের মধ্যে উব্লোর একমাত্র বিপণন-দূত হয়েছেন লোর বুলো। প্রত্যেককেই একটি করে উব্লো বিগ ব্যাং ই উপহার দেওয়া হয়েছে।