ভারত-কানাডার সম্পর্কে আবারও চাপানউতর! কানাডার মাটিতে খলিস্তানপন্থী জঙ্গি হরদীপ সিংহ নিজ্জরকে হত্যার অভিযোগের আচমকা প্রভাবই পড়েছে নয়াদিল্লি-অটোয়া দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিতে।
নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত-কানাডার সম্পর্কের টানাপড়েনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও ওই ঘটনা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে দুই দেশ। কিন্তু কেন বেশ কিছু দিন শান্ত থাকার পর আবারও কালো মেঘ তৈরি হল ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্কের আকাশে?
নিজ্জরকে ২০২০ সালে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করেছিল ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের তরফে কানাডাকে পাঠানো একটি নথিতে জানানো হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে নিজ্জর পাসপোর্ট জালিয়াতি করে কানাডায় গিয়েছিলেন। সেই সময়ে ট্রাকচালক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। পাকিস্তানে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। যদিও কানাডার তরফে সেই দাবি অস্বীকার করা হয়।
পঞ্জাবের জালন্ধরের বাসিন্দা নিজ্জর এর পরেই গুরনেক সিংহের ছত্রছায়ায় ক্রমশ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কুখ্যাত জগতে পরিচিতি তৈরি করেন। ১৯৮০ থেকে ’৯০-এর মধ্যে জঙ্গি সংগঠন খলিস্তান কম্যান্ডো ফোর্সের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
২০১২ সাল থেকে খলিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান জগতার সিংহ তারার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জগদীপের সূত্রেই নিজ্জরের পাক-যোগ গভীর হয়। পাকিস্তান থেকে ফিরে মাদক ও চোরাচালানে প্রাপ্ত অর্থ সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
নয়াদিল্লির অভিযোগ, জগদীপের সঙ্গে যুক্ত হয়েই পঞ্জাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ছক কষেছিলেন হরদীপ। কানাডায় নিজস্ব সংগঠন তৈরি করেন। ওই দলেরই সদস্য ছিলেন মনজিৎ সিংহ ধালিওয়াল, সর্বজিৎ সিংহ, অনুপবীর সিংহ, দর্শন সিংহেরা।
২০১৫ সালে হরদীপের দলের এই সদস্যেরা কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১৪ সালে হরিয়ানার সিরসায় ডেরা সাচ্চা সৌদায় হামলার ছক কষেছিলেন। নিজে ভারতে ঢুকতে না পেরে প্রাক্তন ডিজিপি মহম্মদ ইজ়হার আলমকে নিশানা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর সংগঠনকে। এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে নিজ্জরকে ২০২০ সালে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করে ভারত।
এই ঘোষণার তিন বছর পর গত ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারের একটি গুরুদ্বারের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে চিড় ধরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কানাডাকে দোষারোপ করেছিলেন ভারত ভাগ করতে চাওয়া মৌলবাদী শক্তি খলিস্তানপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য।
অন্য দিকে, কানাডার রাস্তায় খলিস্তানপন্থী সন্ত্রাসবাদী নিজ্জরকে হত্যা করার দায় ভারতের উপর চাপিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ভারত অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।
নিজ্জর খুনে জড়িত সন্দেহে কয়েক জন ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে গত বছর গ্রেফতার করেছিল কানাডা পুলিশের ইন্টিগ্রেটেড হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম (আইএইচআইটি)।
যদিও নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে একের পর এক ভারতীয়কে গ্রেফতার যে নয়াদিল্লি একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না, তা বুঝিয়ে দেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ভারতীয়দের গ্রেফতার হওয়ার খবর তাঁকে সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে জানতে হয়েছে বলে অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন জয়শঙ্কর।
এর পরে চলতি বছরের এপ্রিলে কানাডার নিরাপত্তা বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা (সিএসআইএস) সম্প্রতি তদন্ত রিপোর্টের নির্যাস প্রকাশ করে। তাতে দাবি করা হয়, ২০১৯ এবং ২০২১-এর সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পাকিস্তান এবং ভারত গোপনে সক্রিয় ছিল। এই নিয়েও বিতর্ক মাথাচাড়া দেয়। যদিও সেই অভিযোগকেও ভুয়ো বলে উড়িয়ে দেয় ভারত।
এর পর নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক কয়েক দিন চাপা থাকলেও আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
কানাডা সরকার সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছে, সে দেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে নিজ্জর খুনের ‘সম্পর্ক’ রয়েছে। কানাডা সরকারের তদন্তকারী সংস্থা নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় হাই কমিশনার সঞ্জয়কুমার বর্মাকে ‘স্বার্থ সম্পর্কিত ব্যক্তি’ বলে জানিয়েছিল রবিবার। যদিও কূটনৈতিক রক্ষাকবচ থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ করা হয়নি।
সোমবার সকালে বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরকারের এই পদক্ষেপ ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অযৌক্তিক’ বলে অভিযোগ করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয়, ‘‘বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কানাডা সরকার নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পেশ করেনি।’’
এই নিয়ে সোমবার কড়া প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিল ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। সন্ধ্যায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সঞ্জয়কে ফেরত আনার কথা জানানো হয়।
সেই সঙ্গে নিরাপত্তার কারণে, কানাডা সরকারের নিশানায় রয়েছেন, এমন কূটনীতিকদেরও ফেরত আনা হচ্ছে বলে বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে জানানো হয়। যদিও কানাডা সরকারের দাবি, ভারতীয় ওই কূটনীতিকদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
ভারতীয় হাই কমিশনারকে ফেরানোই শেষ নয়। কানাডা সরকারের অভিযোগের জবাবে ভারতে নিযুক্ত সে দেশের ছ’জন কূটনীতিকেও বহিষ্কার করেছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার। সেই তালিকায় রয়েছেন ভারতে কানডার কার্যনির্বাহী হাই কমিশনার। বিদেশ মন্ত্রকের তরফে কানাডা হাই কমিশনের ছ’জন কূটনীতিককে ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৫৯ মিনিটের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি, ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের অভিযোগ, কানাডার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী খলিস্তানি গোষ্ঠীগুলির সমর্থন পাওয়ার জন্য ট্রুডো সরকার নতুন করে নিজ্জর বিতর্ক সামনে নিয়ে আসছে।
এর পর আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ তুলেছে কানাডা। ট্রুডো সরকারের অভিযোগ, কানাডায় উপস্থিত ভারতীয় এজেন্টরা খালিস্তানপন্থীদের ‘টার্গেট’ করতে লরেন্স বিশ্নোই গ্যাংয়ের সঙ্গে কাজ করছে। যদিও ভারত এখনও এই অভিযোগের উত্তরে কিছু জানায়নি।
সব মিলিয়ে কানাডার মাটিতে খলিস্তানপন্থী জঙ্গি নিজ্জরকে হত্যার অভিযোগ ঘিরে নয়াদিল্লি-অটোয়া কূটনৈতিক টানাপড়েন পৌঁছে গেল পুরোদস্তুর সংঘাতে!
উল্লেখ্য, গত বছর নিজ্জর হত্যায় সম্পর্ক আছে অভিযোগ তুলে এক ভারতীয় কূটনীতিকে বহিষ্কার করেছিল কানাডা। সে সময় কানাডার বিদেশমন্ত্রী মেলানি জোলি জানিয়েছিলেন, ওই ভারতীয় কূটনীতিক গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (আরএডব্লিউ)-এর কানাডার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব সামলাতেন।
ট্রুডো সরকারের ওই পদক্ষেপের জবাবে ভারতে নিযুক্ত কানাডার এক সিনিয়র কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। সোমবার ট্রুডো সরকারের অভিযোগকে, ‘রাজনৈতিক লাভের জন্য ভারতকে অপমান করার একটি ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার’ বলেও জানিয়েছে সাউথ ব্লক। নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ বার আবার নতুন করে সংঘাত দুই দেশের মধ্যে।