ইউক্রেনের পাল্টা চাপে জেরবার রাশিয়া। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার ভিতরে ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনের হাজার হাজার সেনা। সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি স্বয়ং।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্যাঙ্ক এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনা রাশিয়ার সীমান্ত পার করে ৩০ কিলোমিটার ভিতরে চলে গিয়েছে। ঘাঁটি গেড়েছে রাশিয়ার পশ্চিমে কুর্স্ক অঞ্চলে।
রাশিয়ার ভূখণ্ডে টানা সাত দিন ধরে হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন। কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হামলা চালানোর পরে সে প্রসঙ্গে মুখ খুলে বড় মাপের সাফল্য দাবি করেছেন জ়েলেনস্কি। এক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে শনিবার তিনি বলেন, “ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী রাশিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে আক্রমণ শানাচ্ছে।”
জেলেনস্কি শনিবার দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা করার সময় ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘‘ইউক্রেন প্রমাণ করছে যে তারা ন্যায়বিচার করতে জানে।’’
জেলেনস্কির বিবৃতি ইতিমধ্যেই বিশ্ব জুড়ে হইচই ফেলেছে। রাশিয়া যেমন চমকে গিয়েছে, তেমনই অবাক হয়েছে ইউক্রেনের বন্ধু দেশগুলি। সূত্রের খবর, আমেরিকাও নাকি ইউক্রেনের এই পদক্ষেপের কথা আগে থেকে ঠাওর করতে পারেনি।
রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনীয় সেনাদের ছবি, ভিডিয়ো এবং রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরেও ইউক্রেন সরকার এই বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চায়নি। অবশেষে শনিবার জ়েলেনস্কি এই নিয়ে মুখ খোলেন।
কিন্তু কেন হামলার জন্য সীমান্তবর্তী কুর্স্ক অঞ্চলতেই বেছে নিল ইউক্রেন? জ়েলেনস্কি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক কালে ইউক্রেনের উপর রাশিয়া যত হামলা চালিয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে কুর্স্ক অঞ্চল থেকে।
জ়েলেনস্কির কথায়, ‘‘এই গ্রীষ্মের শুরুর পর শুধুমাত্র কুর্স্ক অঞ্চল থেকে আমাদের সুমি অঞ্চলে আর্টিলারি, মর্টার, ড্রোন দিয়ে প্রায় দু’হাজার হামলা হয়েছে।’’ তারই প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইউক্রেন এই পদক্ষেপ করেছে বলেও জানিয়েছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট।
সমাজমাধ্যমেও বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে দেখা গিয়েছে কুর্স্কের কয়েকটি গ্রামে রাশিয়ার পতাকা নামিয়ে ইউক্রেনের পতাকা লাগিয়ে উল্লাস করছে ইউক্রেনীয় সেনা। যদিও ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিয়োগুলিতে দেখা গিয়েছে, কুর্স্কের সড়কে রাশিয়ার অন্তত ১৫টি সামরিক যান ধ্বংস হয়ে পড়ে রয়েছে। সামরিক যানগুলোতে হতাহত রুশ সেনাদের দেহও পড়ে রয়েছে।
কুর্স্কে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী গত শুক্রবার একটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় বলে দাবি করেছে রাশিয়া। জানা গিয়েছে, বিমানঘাঁটিতে থাকা গুদামে প্রচুর বিস্ফোরক মজুত ছিল। হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে গুদামটি।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ আগ্রাসী মোড় নিচ্ছে বলেও দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। ইউক্রেনীয় হামলা ঠেকাতে ইতিমধ্যেই তৎপর হয়েছে মস্কো। ইউক্রেনের অগ্রগতি থামাতে এবং সে দেশের সেনাদের রাশিয়া থেকে তাড়াতে উঠেপড়়ে লেগেছে রুশ সেনা।
রাশিয়ার সেনা কুর্স্ক এবং অন্যান্য দু’টি সীমান্ত অঞ্চলে অভিযান শুরু করেছে। মস্কো থেকেও রুশ সেনা কুর্স্কের পথে রওনা দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে প্রচুর ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এবং অস্ত্র। কুর্স্ক অঞ্চলের প্রতিরক্ষায় ট্যাঙ্ক ও রকেট লঞ্চিং সিস্টেম পাঠিয়েছে মস্কো। ইউক্রেন সীমান্তবর্তী শহর কুর্স্ক, বেলগোরদ ও ব্রিয়ানস্ক অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে মস্কো।
সংঘাতের তীব্রতা বাড়তে কুর্স্ক থেকে কয়েক হাজার রুশ নাগরিককে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কুর্স্কের গভর্নর রবিবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত কুর্স্কের সীমান্ত এলাকা থেকে ৭৬ হাজারেরও বেশি মানুষ তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
রবিবার রাশিয়া জানিয়েছে, ইউক্রেনের তরফে চালানো একটি হামলা ব্যর্থ করেছে তারা। রাশিয়া জানিয়েছে, তারা কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের ১৪টি ড্রোন এবং ৪টি তোচকা-ইউ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। ভোরোনেজ অঞ্চলে ১৬টি ড্রোন, বেলগোরদ অঞ্চলে তিনটি ড্রোন এবং ব্রিয়ানস্ক ও ওরিওল অঞ্চলে একটি করে ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে।
তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, মস্কোর বাধার মুখে নতি স্বীকার না করে ধীরে ধীরে রাশিয়ার আরও ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনা।
এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন সেনাকে ঠেকাতে মরিয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কোনও ‘বড় পদক্ষেপ’ না করে বসেন, তা নিয়েও চিন্তা বেড়েছে আন্তর্জাতিক মহলে।
এর মধ্যেই রবিবার হঠাৎ বিস্ফোরণের জেরে আগুন ধরে যায় ইউক্রেনের জ়াপোরিঝিয়া পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে। রবিবার রাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ারের লেগে যাওয়া আগুন এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলে ইউক্রেন সরকারের দাবি। এর জেরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)!
ইউক্রেন এবং রাশিয়া দু’পক্ষই এই অগ্নিকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছে। পাশাপাশি অভিযোগের আঙুল তুলেছে পরস্পরের দিকে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির অভিযোগ রুশ সেনাই ওই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
অন্য দিকে, জ়াপোরিঝিয়া পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মস্কো-নিযুক্ত প্রধান ভ্লাদিমির রোগোভ এবং জ়াপোরিঝিয়ার রুশ গভর্নর ইয়েভজেনি বালিটস্কি এ ঘটনার জন্য ইউক্রেনের সেনাকে দায়ী করেছেন।
গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে রাশিয়ার। সেই যুদ্ধে আমেরিকা-সহ প্রথম বিশ্বের বহু দেশই দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের পাশে।
গত দু’বছের কিভ-মস্কো সংঘাতের তীব্রতা কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে। তবে একটানা যুদ্ধ চলেছে।
রুশ আগ্রাসনের মুখে হাল ছাড়েনি ইউক্রেন। রীতিমতো লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। তবে এ বার রাশিয়ায় ঢুকে পাল্টা হামলা জ়েলেনস্কি সরকারের। প্রতিহত করতে উদ্যত পুতিনও। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত আরও জোরালো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।