১৯৯২ সালের কুখ্যাত অজমের ধর্ষণ ও হুমকি মামলায় বাকি ছয় অভিযুক্তকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনাল একটি পকসো আদালত। দোষীদের প্রত্যেককে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। ছয় আসামির কাছ থেকে সংগৃহীত ৩০ লক্ষ টাকা নির্যাতিতাদের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন পকসো আদালতের বিচারক রঞ্জন সিংহ।
রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে জেলা আইনি সহায়তা কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে নির্যাতিতাদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সাত লক্ষ টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছে ওই পকসো আদালত। যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁদের অ্যাকাউন্ট খুলে ওই ক্ষতিপূরণের অর্থ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারক সিংহ রায় ঘোষণার সময়ে বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণে ধর্ষিতাদের যন্ত্রণা শেষ হয়তো হবে না, তবে তাঁদের ব্যথা কিছুটা কমতে পারে।’’
মঙ্গলবার সাজাপ্রাপ্ত ছয় ব্যক্তি হলেন— নাফিস চিস্তি, নাসিম চিস্তি ওরফে টারজান, ইকবাল ভাটি, সেলিম গনি চিস্তি, সোহেল গনি চিস্তি ও সইদ জামির হোসেন। বিচার চলাকালীন তাঁরা ছ’জনেই রাজস্থান ছেড়ে পালিয়ে যান। তাঁদের পলাতক ঘোষণা করা হয়। পরে একে একে সকলেই আত্মসমর্পণ করেন।
অজমের ধর্ষণ ও হুমকি মামলার সূত্রপাত ১৯৯২ সালে, ৩২ বছর আগে। রাজস্থানের অজমেরে স্কুলছাত্রীদের ব্ল্যাকমেল করে দিনের পর দিন চলত গণধর্ষণ। মুখ বন্ধ করতে অশালীন ছবি তুলে করা হত ব্ল্যাকমেল। ৩২ বছর আগের এই ঘটনায় নড়ে গিয়েছিল গোটা দেশ। ১০০ জনেরও বেশি কিশোরীকে এ ভাবে হেনস্থা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে।
১৯৯২ সালে অজমের শহরের বুকে এই ধারাবাহিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। তার পর যত তদন্ত এগিয়েছে, ততই উঠে এসেছে একের পর এক নতুন তথ্য। ঠিক কী ঘটেছিল?
ফারুখ চিস্তি এবং নাফিস চিস্তি— এই দুই যুবক সেই সময়ে হয়ে উঠেছিলেন অজমেরের ত্রাস। শহরের কুখ্যাত মস্তান ছিলেন তাঁরা। প্রভাব-প্রতিপত্তি কম ছিল না! পাশাপাশি তাঁরা যুক্ত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গেও।
যুব কংগ্রেসের নেতা ছিলেন ফারুখ এবং নাফিস। এলাকায় তাঁদের একটি গ্যাং ছিল। অজমেরে ধারাবাহিক গণধর্ষণের ঘটনায় ফারুখ এবং নাফিসই ছিলেন মূল অভিযুক্ত।
১৯৯২ সালের ২১ এপ্রিল। স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতা দেখে সে দিন সকালে শিহরিত হয়েছিলেন সকলে।
এলাকার গুন্ডাদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে স্কুলের মেয়েরা— এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল ওই সংবাদপত্রে। খবরের পাশাপাশি কিছু আপত্তিকর ছবিও প্রকাশ করা হয়েছিল। সে সব দেখে হইচই পড়ে গিয়েছিল গোটা শহরে। সংবাদপত্রে এই খবর দেখে টনক নড়ে পুলিশ-প্রশাসনের। শুরু হয় তদন্ত।
তদন্তে উঠে আসে, অজমেরে মেয়েদের স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন ফারুখ। তার পর প্রলোভন দিয়ে তাঁদের সঙ্গে নির্জনে দেখা করে ধর্ষণ করা হত। ধর্ষণের সময়ের ছবিও তুলে রাখা হত ব্ল্যাকমেল করার উদ্দেশ্যে।
তার পর আপত্তিকর ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে আবার ধর্ষণ করা হত নির্যাতিতা ছাত্রীকে। নির্যাতিতাকে বলা হত, তিনি যেন তাঁর বান্ধবীদেরও ফারুখ এবং নাফিসের কাছে পাঠান। আর তা না হলে নির্যাতিতার আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হবে শহর জুড়ে।
এ ভাবেই এলাকার বিভিন্ন স্কুলের একাধিক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করেন ফারুখ এবং নাফিস এবং তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা।
সেই সময় ওই এলাকায় ফারুখ এবং নাফিসের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাজনৈতিক প্রতাপ-প্রতিপত্তিতে ভর করে এলাকায় রাজত্ব করতেন তাঁরা।
ফারুখ এবং নাফিসের নেতৃত্বাধীন গ্যাংয়ের অনেকেই অজমের শরিফ দরগার খাদিম পরিবারের সদস্য ছিলেন। অভিযোগ, সে কারণেই নির্যাতিতা এবং তাদের পরিবার সব জেনেও টুঁ শব্দটি করত না।
ফারুখ এবং নাফিসদের হাতে নির্যাতিতাদের ‘আইএএস-আইপিএসের মেয়ে’ বলে অভিহিত করেছিল স্থানীয় সংবাদপত্র। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কোনও কোনও কিশোরীর বাবা সরকারি কর্মীও ছিলেন।
এই ঘটনার পর বহু নির্যাতিতার পরিবারই অজমের ছেড়ে দেয়। কেউই প্রকাশ্যে এ নিয়ে সরব হননি। বহু দিন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে ঘুরতে থাকেন অভিযুক্তেরা। তবে সংবাদপত্রের ওই প্রতিবেদনই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়।
অপরাধের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তদন্তে নামে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছিল অভিযুক্তদের।
তবে নির্যাতিতারা মুখ খুলতে রাজি না হওয়ায় চাপে পড়েন তদন্তকারীরা। উপরন্তু, সেই সময়ে বেশ কয়েক জন নির্যাতিতার আপত্তিকর ছবি অজমের শহরে ছড়িয়ে পড়ে। যে নির্যাতিতাদের ছবি প্রকাশ্যে আসে, তাঁদের অনেকেই আত্মহত্যা করেন।
এই ঘটনায় মোট ছ’টি চার্জশিট জমা দিয়েছিল পুলিশ। তাতে নাম ছিল ১৮ জন অভিযুক্তের। ১৪৫ জনেরও বেশি সাক্ষীর নাম ছিল। মাত্র ১৭ জন নির্যাতিতা তাঁদের বয়ান রেকর্ড করিয়েছিলেন।
১৯৯৮ সালে অজমেরের একটি দায়রা আদালত আট জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায়। কিন্তু রাজস্থান আদালত তাঁদের মধ্যে চার জনকে মুক্তি দেয়। ২০০৩ সালে অন্য চার জন, মইজুল্লাহ ওরফে পুত্তন, ইশরাত আলি, আনোয়ার চিস্তি এবং শামসুদ্দিনের সাজার মেয়াদ কমিয়ে ১০ বছর করে সুপ্রিম কোর্ট।
২০০৭ সালে ফারুখকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১৩ সালে ফারুখকে মুক্তির নির্দেশ দেয় রাজস্থান হাই কোর্ট। বর্তমানে অজমেরে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
ফারুখ গ্রেফতার হলেও পলাতক ছিলেন নাফিস। ২০০৩ সালে দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে অবশ্য জামিন পান। ফারুখের মতোই এত দিন এলাকায় ছিলেন নাফিস। এর পর মঙ্গলবার তাঁকে এবং বাকি পাঁচ অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে রাজস্থানের একটি পকসো আদালত।
তদন্তকারীরা অনুমান করেছিলেন, অজমেরকাণ্ডে ১০০ জনেরও বেশি কিশোরী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তদন্তের মুখোমুখি হননি। এখনও ৩২ বছর আগের সেই ঘটনার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে অজমের।