রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার নাম নেই। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে বিশেষ ফৌজি অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করে রুশ সেনা। তার পর থেকে হাজার দিন কেটে গেলেও পূর্ব ইউরোপে থামছে না যুদ্ধ। বরং সংঘাতের উত্তাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর মধ্যেই জল্পনা তৈরি হয়েছে, এ বার অন্য একটি দেশে হামলা চালাতে পারে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার! আর সেই দেশ হল জর্জিয়া। কিন্তু কেন?
এই জল্পনা শুরু হয়েছে রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের একটি বার্তায়। টেলিগ্রামে একটি বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘‘জর্জিয়া এখন ইউক্রেনের পথে চলছে। যদি জর্জিয়া এমন কোনও পদক্ষেপ করে, যা রাশিয়ার ভূ-রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলবে, তা হলে রাশিয়াকেও পদক্ষেপ করতে হবে।’’
মেদভেদেভের এই বার্তাতেই হইচই পড়েছে। কিন্তু কেন এমন বার্তা দিলেন তিনি?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার আগে রাশিয়ারই অংশ ছিল জর্জিয়া। সেই জর্জিয়াতেই একটি তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধছে, যা থেকে শুরু হয়েছে দেশব্যাপী বিক্ষোভ। জর্জিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হওয়া উচিত কি না তা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। রাস্তায় নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। বিগত পাঁচ দিন ধরে সেই বিক্ষোভ তীব্রতর হচ্ছে।
জর্জিয়ার রাজধানীতে পাঁচ দিনের টানা বিক্ষোভের পরে ২০০ জনেরও বেশি লোককে আটক করা হয়েছে।
ওই বিতর্ককে কেন্দ্র করে সে দেশের প্রেসিডেন্ট এবং নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও সংঘাত শুরু হয়েছে।
গত ২৬ অক্টোবর জর্জিয়ার সংসদীয় নির্বাচনে জয় পেয়েছে ‘ড্রিম পার্টি’। যদিও সেই জয় নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট সালোমে জোরাবিচভিলি দেশটির নবগঠিত সরকারকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করেছেন।
জোরাবিচভিলির অভিযোগ, মস্কোর সহায়তায় ভোটে কারচুপি হয়েছে। বাগ্স্বাধীনতা নষ্ট করতে এবং নির্বাচনে কারচুপির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘রাশিয়ান পদ্ধতি’।
অন্য দিকে, জোরাবিচভিলির পদত্যাগের দাবি তুলেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি কোবাখিদজে। তবে জোরাবিচভিলি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘বৈধ’ সরকার গঠিত না হলে পদত্যাগ করবেন না তিনি।
জর্জিয়ার সাধারণ নাগরিকদের একাংশও প্রেসিডেন্টের সুরে কথা বলছেন। সে দেশের পার্লামেন্ট বয়কটের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে নবনির্বাচিত সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আলোচনা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়েছে। রাস্তায় নেমেছেন হাজার হাজার নাগরিক। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বহু মানুষ আহত হয়েছেন। আটকের সংখ্যা আড়াইশো পেরিয়েছে।
উল্লেখ্য, ড্রিম পার্টির বিরুদ্ধে ‘রাশিয়া-প্রেমের’ অভিযোগ আগেও উঠেছে। তবে বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থিতিশীল। যদিও জর্জিয়ার অনেক পক্ষেরই অভিযোগ, ড্রিম পার্টির সঙ্গে বিশেষ সখ্য রয়েছে রাশিয়ার। এবং নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য দলটি রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে।
পশ্চিমি দেশগুলির পথ অনুসরণ করুক জর্জিয়া, এই দাবি নিয়েই রাস্তায় নেমেছেন সে দেশের মানুষ। কারণ, রাশিয়ার অতীত এখনও তাঁরা ভোলেননি।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই রাশিয়া এবং জর্জিয়া বিভক্ত। ২০০৮ সালে উভয় দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জর্জিয়ার কিছু ভূখণ্ড রাশিয়া নিজের বলে দাবি করার পর সেই সংঘাত বেধেছিল।
সোভিয়েতের পতনের পরে জর্জিয়া স্বাধীন হয়। সেই সময়ে জর্জিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দক্ষিণ অসেশিয়া প্রদেশ। পাল্টা তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে সেনা পাঠায় জর্জিয়া। ১৯৯১-৯২ সালে যুদ্ধ বাধে। তবে সমস্যার নিষ্পত্তি হয় না।
সংবিধান রচনা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, পৃথক অর্থনীতি— নিজেদের মতো করে চলতে থাকে দক্ষিণ অসেশিয়া। ফের ২০০৪-এ যুদ্ধ। স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাহারের শর্তে দক্ষিণ অসেশিয়াকে স্বায়ত্তশাসন দিতে চায় জর্জিয়া। কিন্তু দক্ষিণ অসেশিয়া গণভোট করে আলাদা হতে চায়। সেখানে সাময়িক প্রশাসন তৈরি করতে চেয়ে আইন পাশ করে জর্জিয়া।
আলোচনার আন্তর্জাতিক উদ্যোগও ভেস্তে যায়। অন্য দিকে, সার্বিয়া থেকে কসোভো স্বাধীন হওয়ার পরে অসেশিয়ানদের দাবি জোরদার হয়। ক্ষমতা ভাগ করে নিতে রাজি হয় না তারা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে স্কিনভালি (দক্ষিণ অসেশিয়ার রাজধানী) মুক্ত করার কথা বলে জর্জিয়ার সরকার। রাশিয়ার চক্রান্তের গন্ধ পায় তারা। ২০০৮-এর যুদ্ধে ঢুকে পড়ে রাশিয়া। মস্কোর সাহায্যে নিজেদের এলাকা দখল করে নেয় দক্ষিণ অসেশিয়া। জর্জিয়ার জন্য সেই অতীত ভোলার নয়।
আর তাই রাশিয়াকে আপন না-করে নেওয়ার দাবি তুলেছেন জর্জিয়ার বিক্ষোভকারীরা।
তবে পুরো বিষয়টিকে রাশিয়া যে মোটেও ভাল চোখে দেখছে না, তা স্পষ্ট মেদভেদেভের বার্তা থেকে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও সোমবার জানিয়েছেন, জর্জিয়ার ঘটমান পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনের ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের ঘটনাগুলিকে সমান্তরাল ভাবে বিবেচনা করছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের তৎকালীন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর না-করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই কারণে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সে দেশে। যেমনটা এখন জর্জিয়ায় হচ্ছে। তাই কূটনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, ইউক্রেনের মতো জর্জিয়ার উপরেও হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। ছত্রভঙ্গ করতে পারে আন্দোলনকারীদের।
তবে অনেকে এ-ও মনে করছেন, প্রতিবেশী জর্জিয়া নিয়ে রাশিয়ার এত মাথা ঘামানোর কারণ অন্য।
এর অন্যতম কারণ পৃথিবীর মানচিত্রে জর্জিয়ার অবস্থান। জর্জিয়ার এক পাশে কাস্পিয়ান সাগর, অন্য দিকে কৃষ্ণসাগর। কাস্পিয়ান সাগর প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভার। কৃষ্ণসাগর বিখ্যাত বাণিজ্যিক রাস্তা। আর তা হাতের মুঠোয় রাখতেই নাকি এ বার জর্জিয়ায় হামলা চালাতে পারে রাশিয়া।