ইজ়রায়েল-হামাস চলতি সংঘাতের জন্য নাকি তিনিই দায়ীই। হামাসের হয়ে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে অতর্কিতে হামলা চালানোর নেপথ্যে নাকি ছিল তাঁরই মাথা।
তিনি হলেন ইয়াহা সিনবার। ৬৩ বছর বয়সি এই ব্যক্তির জীবনের ২৪টি বছরই কেটেছে ইজ়রায়েলের জেলে।
সিনবারকে আগেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে ঘোষণা করেছে আমেরিকা। ইজ়রায়েলের তরফে তাঁকে ‘প্যালেস্তাইনের ওসামা বিন লাদেন’ বলা হয়েছে।
একাধিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধাপে ধাপে প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র সংগঠন হামাসের শীর্ষ স্তরে পৌঁছন সিনবার। ২০১৭ সালে হামাস অধিকৃত গাজ়া ভূখণ্ডের সর্বোচ্চ শাসক নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৬২ সালে দক্ষিণ গাজ়ার খান ইউনিসে জন্ম সিনওবারের। দক্ষিণ গাজ়া তখন মিশরের অধীন। তাঁর এই জন্মস্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই ইজ়রায়েলি সেনা সিনবারকে ‘খান ইউনিসের কসাই’ বলে কটাক্ষ করে থাকে।
সিনবার-ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বলে থাকেন, তাঁর পরিবার নাকি আগে বসবাস করত আল মাজদল শহরে। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর এই শহর প্যালেস্তাইনের হাতছাড়া হয়। শহরটির নাম বদল করে রাখা হয় অ্যাশকেলন।
অনেকেই মনে করেন, সিনবারের পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যেই ইজ়রায়েল-বিরোধিতার বীজ লুকিয়ে ছিল। সিনবার তাঁর কাজকর্মের মাধ্যমে সেই বীজকে কার্যত মহীরুহে পরিণত করেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতায় সিনবার স্নাতক। গাজ়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যারাবিক স্টাডিজ় নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনেই ইজ়রায়েল-বিরোধী একাধিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ১৯৮২ সালে প্রথম গ্রেফতার হন সিনবার। তার পর একাধিক বার দফায় দফায় গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। আশির দশক থেকেই হামাসের আর এক নেতা সালাহ্ শেহাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের উপর হামলা চালাতে থাকেন সিনবার।
১৯৮৭ সালে একটি গোষ্ঠী হিসাবে হামাস আত্মপ্রকাশ করার পর নিজের সংগঠনকে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন সিনবার। তিনি হামাসে যোগ দেওয়ার পর ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালানোর ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
একাধিক বার গ্রেফতার করেও সিনবারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ইজ়রায়েলি প্রশাসন। বরং তাঁর কাজে বার বার বিপাকে পড়তে হয়েছে তুলনায় সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত ইজ়রায়েলকে।
১৯৮৮ সালে দু’জন ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যার ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন সিনবার। সেই সঙ্গে চার জন প্যালেস্তিনীয় ব্যক্তি ইজ়রায়েলিদের হয়ে কাজ করছেন, এমন অভিযোগে খুন হয়ে যান। এই হত্যাকাণ্ডেও নাম জড়ায় সিনবারের।
২০০৬ সালে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ইজ়রায়েলে ঢোকে হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জাদ-দিন আল-কাসাম। ইহুদি-প্রধান দেশটিতে ঢুকে তারা দুই ইজ়রায়েলি সেনাকে হত্যা করে, এক জনকে পণবন্দি করে।
পণবন্দি সেনার মুক্তির বিনিময়ে সিনবারকে ছাড়তে বাধ্য হয় ইজ়রায়েল। শুধু সিনবার নয়, আরও বেশ কয়েক জন প্যালেস্তিনীয়কেও ছাড়তে বাধ্য হয় তেল আভিভ প্রশাসন।
২০১১ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে হামাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সিনবার। হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হ্যানিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার পর সিনবারই বর্তমানে হামাসের অলিখিত প্রধান।
সিনবার পরিচিত তাঁর অনমনীয় নীতির জন্যই। ইজ়রায়েল প্রশ্নে কোনও আপসরফায় যেতে রাজি নন তিনি। বরং একাধিক সভায় গরম গরম বক্তৃতা করে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে প্যালেস্তিনীয়দের একজোট করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
তবে হামাসের অন্দরেও সিনবারকে নিয়ে বিতর্ক দেখা গিয়েছে। হামাস কম্যান্ডার মাহমুদ ইশতিইয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। পাশাপাশি জানা গিয়েছিল, তিনি সমকামী। এর পরে ২০১৫ সালে খুন হয়ে যান মাহমুদ।
অভিযোগ ওঠে যে, হামাসের ঘোষিত নীতির সঙ্গে আপস করবেন না বলে মাহমুদকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন সিনবারই।
গত ৭ অক্টোবর অতর্কিতে ইজ়রায়েলের উপরে হামলা চালায় হামাস বাহিনী। মৃত্যু হয় ১৩০০ ইজ়রায়েলির। ইজ়রায়েলের বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থাগুলি কেন এই হামলার আগাম খবর পেল না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
ইজ়রায়েলি সেনার দাবি, এই হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন সিনবার। সেনার মুখপাত্র রীতিমতো হুঁশিয়ারির সুরে জানান, সিনবার এবং তাঁর সহযোগীরা ইজ়রায়েলি সেনার নজরে রয়েছেন। সিনবারকে যে ইজ়রায়েল নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ দিতে চায়, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে ইজ়রায়েলি সেনা।