দিল্লিতে শ্রদ্ধা ওয়ালকর খুনের ঘটনা গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছে। খুনের বীভৎসতায় শিউরে উঠেছেন সকলে। ছতরপুরের ফ্ল্যাটে আফতাব আমিন পুনাওয়ালার কীর্তি মনে করিয়ে দিয়েছে ১২ বছর আগের আরও এক নৃশংসতাকে।
প্রেমিকা তথা লিভ-ইন সঙ্গী শ্রদ্ধাকে খুন করার পর আফতাব গুগলে কী কী সার্চ করেছিলেন, তা খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। দেখা গিয়েছে, ১২ বছর আগের অনুপমা গুলাটি হত্যাকাণ্ড আফতাবের অনুসন্ধানের তালিকায় ছিল।
ঠিক কী হয়েছিল ১২ বছর আগে? কী ভাবে খুন হয়েছিলেন অনুপমা? বস্তুত, অনুপমাকে খুন করেছিল তাঁর স্বামী রাজেশ গুলাটি। শ্রদ্ধা-হত্যার সঙ্গে সেই খুনের অনেক মিল রয়েছে।
১৯৯৯ সালে রাজেশ-অনুপমার বিয়ে হয়। তাঁরা প্রথমে আমেরিকায় থাকতেন। ২০০৮ সালে দেহরাদূনে চলে আসেন। তার পর থেকেই অশান্তির সূত্রপাত।
কলকাতার কোনও মেয়ের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন রাজেশ, এমনটাই সন্দেহ ছিল স্ত্রী অনুপমার। সেই নিয়ে সংসারে নিত্য অশান্তি লেগে থাকত। তাঁদের যমজ দুই ছেলের বয়স ছিল ৪।
২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর। সে রাতে রাজেশ-অনুপমার দাম্পত্যকলহ চরম আকার নিয়েছিল। রাগের মাথায় স্ত্রীকে সজোরে ধাক্কা মেরেছিলেন রাজেশ। দেওয়ালে মাথা ঠুকে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন অনুপমা।
জ্ঞান ফেরার পর পাছে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন, সেই আশঙ্কায় স্ত্রীকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেন রাজেশ। জীবিত অবস্থাতেই তাঁর নাকে-মুখে তুলো গুঁজে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেন অনুপমাকে।
খুনের পর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে অনুপমার দেহ টুকরো টুকরো করে কাটেন পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাজেশ।
মোট ৭০ টুকরো করা হয় দেহ। তার পর ফ্রিজে সেই দেহাংশ আলাদা আলাদা প্যাকেটে মুড়ে রেখে দেন রাজেশ। ফ্রিজে রাখা ছিল অনুপমার কাটা মাথাও।
ছেলেদের স্কুলে দিয়ে আসার সময় পথে স্ত্রীর দেহের টুকরো ছড়িয়ে দিতেন রাজেশ। দেহরাদূনের রাস্তায়, ঝোপঝাড়ে ছড়ানো হয়েছিল অনুপমার দেহাংশ।
২ মাস সকলের চোখকে ধুলো দিয়ে থাকতে পেরেছিলেন রাজেশ। ছেলেদের বলতেন, মা বেড়াতে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর কীর্তি ফাঁস হয়ে যায়।
অনুপমার ভাই সুজনকুমার প্রধান রাজেশের বাড়ি গিয়েছিলেন দিদির সঙ্গে দেখা করতে। দেখা তো হয়নি, উল্টে বাড়িতে তাঁকে ঢুকতেও দিতে চাননি রাজেশ। সন্দেহ হওয়ায় পুলিশের দ্বারস্থ হন সুজন। নিখোঁজ ডায়েরি করেন থানায়।
পুলিশ অভিযোগ পেয়ে রাজেশের বাড়ি তল্লাশি চালায়। ফ্রিজে পাওয়া যায় অনুপমার টুকরো টুকরো দেহাংশ। কাটা মাথাও উদ্ধার করে পুলিশ।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর শিউরে উঠেছিল দেশ। রাজেশের মানসিক বিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
আদালতে রাজেশের মামলা চলে দীর্ঘ দিন। অবশেষে দেহরাদূনের আদালত রাজেশকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় ২০১৭ সালে।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে রাজেশকে ১৫ লক্ষ টাকা জরিমানাও করা হয়। দেহরাদূনের জেলে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ভোগ করছেন রাজেশ।
জেলে রাজেশের কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় সম্প্রতি কিছু দিনের জন্য তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। রাজেশের অস্ত্রোপচারও হয়েছে বলে খবর। গত সেপ্টেম্বর মাসে সেই জামিনের মেয়াদ ২১ দিনের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অনুপমা গুলাটি হত্যাকাণ্ড শ্রদ্ধা-হত্যার সঙ্গে যেন হুবহু মিলে গিয়েছে। আফতাবের আচরণ মিলে গিয়েছে রাজেশের সঙ্গে। দু’জনেই আক্রোশের বশে সঙ্গীকে খুন করেছেন।
অনুপমার মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য স্ত্রীর ই-মেল থেকে নিয়মিত পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন রাজেশ। অনুপমার অনুপস্থিতি নিয়ে কারও যাতে সন্দেহ না হয়, সেই ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজেশের কীর্তি গুগল সার্চ করেছিলেন দিল্লির আফতাবও। তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে ১২ বছর আগে দেহরাদূনের ঘটনার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।
আফতাব অবশ্য পুলিশকে জানিয়েছেন, আমেরিকার জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘ডেক্সটার’ দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাজেশ তেমন কোনও সিনেমা বা সিরিজ দেখেছিলেন বলে জানা যায়নি।