বছরভর ধরে একে একে অনেকেই ইহজগৎ ছেড়েছে। দেহ রেখেছে ভ্যালেরি পোলার্ড এবং ফ্রান্সিস ‘বুচ’ ডিঙ্গল। এই ক’দিন আগেই সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে মারা গিয়েছে ফেথ ডিঙ্গলও। তাদের শ্রদ্ধা জানাতে ইংল্যান্ডের এক কবরখানায় ভিড় জমাচ্ছেন ভ্যালেরিদের অনুরাগীরা।
কবরখানায় গিয়ে ভ্যালেরিদের স্মৃতিসৌধে অনেকে আবার ফুলমালাও চড়িয়ে আসেন। তফাত হল, ভ্যালেরিরা কেউ রক্তমাংসের মানুষ নয়, কাল্পনিক চরিত্র। অর্ধশতক ধরে ব্রিটিশ টেলিভিশনে রমরমিয়ে চলা ‘এমারডেল’ সিরিজ়ে তাদের দেখা গিয়েছে।
ইংল্যান্ডের লিডস থেকে গাড়িতে চেপে মোটে আধ ঘণ্টা দূরে রয়েছে ওই কবরখানা। সেখানে ঘোরাফেরা করার জন্য গাইড-সহ ট্যুরের বন্দোবস্তও রয়েছে। ফলে এই কবরখানা ঘিরে জমজমাট ব্যবসাও ফেঁদে বসেছেন অনেকে। পর্যটকদের পাশাপাশি সেখানে ভিড় করেন ‘এমারডেলে’র অনুরাগীরাও।
ব্রিটিশ টেলি-সিরিজ়ের দর্শকদের কাছে ‘এমারডেলে’র নাম নতুন করে বলার নেই। সেই ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর এর প্রথম পর্ব দেখা গিয়েছিল আইটিভি টেলিভিশন নেটওয়ার্কে। তার পর থেকে গত ৫০ বছরে ৩৩টি মরসুম কাটিয়ে ফেলেছে এ সিরিজ়।
যদিও গোড়ায় এ সিরিজ়ের নাম ছিল ‘এমারডেল ফার্ম’। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সে নামেই দর্শকদের মন জয় করেছিল ‘সাগডেন’, ‘বেটস’, ‘টেট’, ‘উইন্ডসর’ বা ‘অ্যান্ডারসন’ পরিবারের লোকজন। বছরের পর বছর ধরে তাদের কাণ্ডকারখানায় মজে ‘এমারডেলে’র অনুরাগীরা।
ইয়র্কশায়ার ডেলসের কাল্পনিক গ্রাম ‘ইমারডেলে’ ভ্যালেরিদের ঘরবাড়ি। ব্রিটিশ নাট্যকার, লেখক, অভিনেতা তথা থিয়েটার পরিচালক কেভিন লাফানের কলমের ছোঁয়ায় এই সিরিজ়ের চরিত্ররা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে টিভির পর্দায়।
সিরিজ়ের কাল্পনিক চরিত্রদের ঘরবাড়ির অন্দরের দৃশ্যগুলি শুটিং করা হয়েছিল লিডস স্টুডিয়োয়। তবে বর্হিদৃশ্যগুলি তোলা হয় লিটনডেলে। অনেকের মতে, লিটনডেলের পুরনো নাম অ্যামারডেলের সঙ্গে মিল রেখেই এ সিরিজ়ের নামকরণ করা হয়েছিল।
পরের দিকে ‘এমারডেলে’র বহির্দৃশ্যগুলির শুটিংয়ের জন্য সিরিজ়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে যাওয়া হত ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের এসল্ট গ্রামে। যদিও আজকাল হেয়ারউড এস্টেটের একটি ফার্মহাউসে সেট তৈরি করে সেখানেই শুটিং চলে।
টিভির পর্দায় ‘এমারডেল’ গ্রামটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টার কসুর করেননি এর নির্মাতারা। আউটডোর সেটে লন্ডনের বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ক্যাফে, পাবের দেখা মেলে। সবই সেটের অঙ্গ। তার মধ্যে ‘উলপার্ক পাব’, ‘দ্য ক্যাফে’, ‘হোম ফার্ম’-সহ এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ির বহিরঙ্গও হুবহু তুলে আনা হয়েছে সেটের ভিতর।
বছরের পর বছর ধরে এ সিরিজ়ের নাটকীয়তা বজায় রাখতে একে একে বহু চরিত্রের বিদায় ঘটেছে। ভ্যালেরিদের মতোই ট্রিশিয়া ডিঙ্গল বা অ্যালান টার্নাররা পর্দায় মারা গিয়েছে।
লিডসের অদূরে সেন্ট মেরি’জ় গির্জার কবরখানায় ওই কাল্পনিক চরিত্রদের কবরের উপর অবশ্য সত্যিকারের স্মৃতিসৌধ রাখা হয়েছে। সিরিজ়ের একটি পর্বে দেখা গিয়েছে, সম্প্রতি ওই গির্জায় বিয়ে করেছে মার্লন ডিঙ্গল এবং রোনা গসকার্ক।
তবে কবরখানা ঘিরেই নাকি ভিড়ের কৌতূহল বেশি। প্রতিটি কবরের স্মৃতিসৌধে ওই কাল্পনিক চরিত্রের নামে কিছু না কিছু খোদাই করা রয়েছে। ট্রিশিয়ার কবরের সৌধে যেমন তার পরিচয়ে লেখা রয়েছে, ‘‘মার্লন ডিঙ্গলের পরমপ্রিয় স্ত্রী এবং একনিষ্ঠ নাতনি ও কন্যা।’’
একই ভাবে অ্যালান টার্নারের কবরের পাথরে খোদাই করা, ‘‘আমাদের সঙ্গে কাটানো সময়ের মতোই আনন্দে ভরে উঠুক আপনার পরের সফর।’’ যেমনটা বাস্তবে দেখা যায়!
অ্যালানের কবরের কাছেই শায়িত সারা সাজডেনের কাল্পনিক দেহ। ২০০০ সালের অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিল সারা। তার কবরে লেখা, ‘‘জ্যাকের স্ত্রী এবং রবার্ট, অ্যান্ডি এবং ভিক্টোরিয়ার মা।’’
সেন্ট মেরি’জ় চার্চের এই কবরখানায় সব কিছুই কি কাল্পনিক? তা বলা যায় না। এখানে সত্যিকারের কবরখানার কয়েকটি স্মৃতিসৌধও রয়েছে।
১৯৯৭ সালে লন্ডনের একটি কবরখানায় সংস্কারের সময় ‘এমারডেলে’র সেট তৈরির কাজ চলছিল। সে সময় ওই কবরখানার কয়েকটি স্মৃতিসৌধ ওই সেটে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। ওই কবরখানায় ঘোরাফেরার সময় এমারডেল ট্যুর কর্তৃপক্ষের তরফে পর্যটকদের এ ধরনের বহু খুঁটিনাটি তথ্য জানানো হয়।
কবরখানায় আর একটি সৌধও রয়েছে। ক্রসের আকারের সে সৌধ রাখা হয়েছে এই সিরিজ়ের সেই সব চরিত্রদের স্মরণে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে গিয়েছিল। বাস্তবের এত কাছাকাছি সিরিজ়ে এ ধরনের বহু টুকরো গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। গল্প হলেও যা সত্যি বলেই মনে হয়!