পাড়ার লোকের কাছে তাঁর পরিচিতিই ছিল ‘প্রেগন্যান্ট ম্যান’ হিসাবে। কারণ তাঁর স্ফীতোদরের সঙ্গে এক জন অন্তঃসত্ত্বার চেহারার কোনও ফারাক ছিল না। শরীরের বাকি অংশ মোটামুটি স্বাভাবিক। বলতে গেলে কিছুটা ‘হাড়গিলে’ ধাঁচের চেহারা। অথচ পেটটি অস্বাভাবিক ফুলে থাকত। যেন যত মেদ সেখানেই এসে জমা হয়েছে!
নাম সঞ্জু ভগৎ। বাড়ি নাগপুরে। জন্ম ১৯৬৩ সালে। শরীরের এই অস্বাভাবিক আকৃতি নিয়ে সঞ্জুকে অনেক বক্রোক্তি শুনতে হলেও তিনি সে সবে পাত্তা দেননি।
দিন আনা-দিন খাওয়া সংসারের জোয়াল ছিল কাঁধে। রোজ গতরে খাটতে হলে শরীরের দিকে তাকালে চলে না। সময়ও ছিল না সঞ্জুর। তাই যাবতীয় কটাক্ষ সহ্য করে মুখ বুজে কাজ করে যেতেন তিনি। কিন্তু শরীরই তাঁকে মুখ বন্ধ করতে দিল না।
সঞ্জুর বয়স যখন ২৫-এর আশপাশে, তখনই চোখে পড়ার মতো বাড়তে শুরু করেছিল পেটের ফোলা ভাব। পরিবারের অনেকেই বলেছিলেন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য।
অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারছিলেন সঞ্জু নিজেও। কিন্তু তিনি ভেবেই পাচ্ছিলেন না, যেখানে তিনি রোজ পুষ্টিকর খাবারই খেতে পারেন না সেখানে তাঁর শরীরে এত মেদ জমছে কোথা থেকে।
ভারী ভাব ছাড়া আর কোনও শারীরিক অসুবিধা ছিল না। তাই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বিলাসিতা মনে হয়েছিল সঞ্জুর। তা ছাড়া বাবা-মায়ের কাছে জেনেছিলেন, জন্মগত কোনও রোগ ছিল না তাঁর। ছোটবেলায় স্বাস্থবান শিশু বলেই জানতেন সবাই।
বছর দশেক এ ভাবেই কেটে গিয়েছিল। এক দিন হঠাৎই সঞ্জু বুঝতে পারলেন তাঁর শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। তার স্ফীতোদর এতটাই ফুলেফেঁপে উঠেছে যে, তা প্রায় পাঁজর ঠেলে বেরোতে চাইছ।
কিছুটা প্রাণের ভয়েই এর পরে চিকিৎসকের কাছে যান সঞ্জু। সেটা ১৯৯৯ সাল। মুম্বইয়ের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা প্রথমে তাঁকে দেখে ভেবেছিলেন, তাঁর পেটের ভিতরে টিউমার হয়েছে। কিন্তু সেই ধারণা কতটা ভুল তা তারা জানতে পারলেন অস্ত্রোপচারের টেবলে।
চিকিৎসকেরা সঞ্জুর পেটে ছুরি দিয়ে চিরতেই তার ভিতর থেকে চলকে বেরিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণে জৈবরস। তার পরে বেরিয়ে আসে একটি সম্পূর্ণ মানবদেহ!
এই ঘটনার রিপোর্ট বলছে, যে চিকিৎসকের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার চলছিল, তিনি সঞ্জুর পেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে প্রথমে বলেন, ‘‘ভিতরে প্রচুর হাড়গোড় রয়েছে দেখতে পাচ্ছি।’’
প্রথমে একটি পা বেরিয়ে আসে, তার পর আরও একটি পা। শরীরে জননাঙ্গের কিছু অংশও হাতে উঠে আসে তাঁর।
এর পর একে একে চিকিৎসক বের করে আনেন চুলের কিছু অংশ, পায়ের কিছু অংশ, চোয়াল, গলা, হাড়গোড়— অনেক কিছুই।
সেই সময় যাঁরা অপরেশন থিয়েটারে ছিলেন, তাঁরা নাকি আতঙ্কে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। এক চিকিৎসক সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা সেই সময় বুঝতেই পারছিলাম না কী করব। একই সঙ্গে আতঙ্ক আর বিস্ময় ঘিরে রেখেছিল আমাদের।’’
আর অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক তখনও বলে চলেছেন, ‘‘আরে আমি তো আসলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে এক জনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে পারছি!’’
পরে চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন এটি আসলে একটি বিরল ঘটনা। যেখানে মায়ের গর্ভে একটি ভ্রূণের ভিতরে আরও একটি ভ্রূণ জন্ম নেয়।
চিকিৎসাশাস্ত্রে এই ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ‘ফিটাস ইন ফিটু’। যেখানে মা যমজ সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু এক সন্তানের ভিতরেই জন্ম নেয় আর এক জন।
এক জন স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও অন্য জন তার ভিতরে পরজীবীর মতো বাড়তে থাকে এ ক্ষেত্রে। সাধারণত যাঁর শরীরের ভিতরে এ সব হচ্ছে, তিনি ধীরে ধীরে বিষয়টি টের পান। কিন্তু ভগৎ সেই সব উপসর্গ হেলায় এড়িয়ে গিয়েছেন।
যে চিকিৎসকেরা ভগতের চিকিৎসা করেছিলেন, তাঁরা জানিয়েছেন, ভগৎ তাঁর শরীর থেকে বেরনো যমজ ভাইয়ের দেহ দেখতে চাননি। সেই সমস্ত অগঠিত হাড়গোড়, মাংসপিণ্ড, চুলের দিকে ফিরেও তাকাননি তিনি।
এখন সঞ্জু তাঁর নাগপুরের বাড়িতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করছেন। আর্থিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। তাই এখনও প্রতি দিন কাজের খোঁজে বেরোতে হয় তাঁকে। স্ফীতোদর উধাও হওয়ায় শারীরিক সক্ষমতা এসেছে ঠিকই। কিন্তু এখনও তাঁকে ‘প্রেগন্যান্ট ম্যান’ বা গর্ভবান পুরুষ বলেই চিনতে পারেন আশপাশের মানুষজন।