ব্রিটেনের ইতিহাসে ভিক্টোরিয়ান যুগকে এক বিচিত্র সময়কাল বলে ধরা হয়। ইংল্যান্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল যদিও ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল, তবু ইতিহাসবিদরা মনে করেন যুগধর্ম বিচার করলে এই কাল ১৮২০ থেকে ১৯১৪ বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুত্রপাত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই যুগে এক দিকে যেমন ব্রিটেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়ায়, তেমনই সে দেশে বিজ্ঞান, সাহিত্য বা শিল্পকলার বিশেষ বিকাশ ঘটে। কিন্তু একই সঙ্গে এই যুগ চিহ্নিত হয়ে রয়েছে বিচিত্র সব বিশ্বাস বা প্রথার জন্য, যার সঙ্গে সমকালের অন্যান্য ভাবনাকে মেলাতে বেশ কষ্ট হয়।
ভিক্টোরীয় আমলে মৃত্যুকে ঘিরে বেশ কিছু অদ্ভুত কার্যকলাপ শুরু হয়। এমন কিছু প্রথা এই সময়ে জন্ম নেয়, যেগুলির কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। মনে রাখা দরকার, ভিক্টোরীয় যুগ ছিল ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে ভয় এবং রহস্য সাহিত্যের উদয়ের কাল। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সেই সব সাহিত্যের নেপথ্যে কাজ করেছিল ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা আর বিভিন্ন আচার।
ভিক্টোরীয় যুগে মৃতের প্রতি শোকপ্রকাশ করতে প্রচলন ঘটে ‘মোর্নিং জুয়েলারি’র। সাধারণত আংটি বা লকেটে মৃত প্রিয়জনের নাম, মৃত্যুর তারিখ বা ছবি খোদাই করা হত। আংটিগুলিতে সাধারণত কালো পাথর বসানো থাকত। এ ধরনের আংটির চল ১৪ শতকেও ছিল। তবে, ভিক্টোরীয় আমলে শোকপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ‘মোর্নিং রিং’ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আংটিতে কালো পাথর বা প্রয়াত প্রিয়জনের ছবিওয়ালা লকেট অবশ্য কিছুই নয়। ভিক্টোরীয়রা প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশের জন্য এক বিশেষ গয়নার প্রচলন করেন। মৃত প্রিয়জনের চুল কেটে তাতে বিশেষ প্যাটার্ন তৈরি করে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে পেন্ড্যান্ট বা লকেট বানিয়ে নিতেন সে যুগের মহিলারা। অনেক সময় ‘মোর্নিং রিং’-এও বাঁধিয়ে রাখা হত মৃত প্রিয়জনের চুল। সেই সময় পুরুষদের লম্বা চুল রাখার রেওয়াজ ছিল। ফলে মৃত ব্যক্তির মাথা থেকে একগুচ্ছ চুল কেটে নিয়ে তা দিয়ে নকশা তৈরি খুব দুরূহ কাজ ছিল না।
মৃত ব্যক্তির মুখের উপরে প্লাস্টার লেপে তাঁর মুখমণ্ডলের ছাঁচ থেকে তৈরি করা হত ‘ডেথ মাস্ক’। ফোটোগ্রাফি যখন ভাল করে প্রচলিত হয়নি, তখন ডেথ মাস্কই ছিল মৃত প্রিয়জনের অবয়বকে সংরক্ষিত রাখার উপায়। মুখমণ্ডলের সঙ্গে অনেক সময় মৃত ব্যক্তির দু’হাতের প্লাস্টার-কাস্টও রেখে দেওয়া হত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। আবার সব সময়ে যে মৃত মানুষের মুখাবয়বকেই প্লাস্টারে ধরে রাখা হত, এমন নয়। জীবিত মানুষও অনেক ক্ষেত্রে নিজের ডেথ মাস্ক তৈরি করিয়ে রাখতেন।
ভিক্টোরিয়ান আমলে শোকপ্রকাশের জন্য বিশেষ পোশাক পরার রীতি চালু হয়। স্বামী অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর রানি ভিক্টোরিয়া স্বয়ং শোকপ্রকাশের জন্য টানা তিন বছর শোকপোশাক পরেছিলেন। এই পোশাকের রং অনিবার্য ভাবে কালো হত। আবার প্রবল শোকপ্রকাশ করতে মহিলারা চকচকে নয়, এমন কালো রঙের পোশাক পরতেন। বিধবা মহিলাদের মুখের উপরে ‘উইপিং ভেল’ বা ‘ক্রন্দন-পর্দা’ ধারণ ছিল সাধারণ ঘটনা। শোক একটু কমলে মহিলারা ‘হাফ মোর্নিং’ পোশাক পরতেন। সেই পোশাকের রং হত ধূসর বা ল্যাভেন্ডার রঙের।
ভিক্টোরীয় সমাজে শোকপালনের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকত। কোন সম্পর্কের মানুষ মারা গিয়েছেন, তার উপর নির্ভর করত এই সময়। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোন— প্রত্যেক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধরা থাকত নির্দিষ্ট শোকপর্ব। যেমন, স্বামী মারা গেলে মহিলাদের এক বছর গির্জা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে স্ত্রী মারা গেলে শোকপালনের নিয়ম অত কঠোর ছিল না। কাকা-কাকিমা, মাসি-মেসো, পিসি-পিসে মারা গেলে শোকের মেয়াদ ছিল দু’মাস। কিন্তু সন্তান মারা গেলে বাবা-মাকে এক বছর শোক পালন করতে হত।
ভিক্টোরীয় সমাজে অতিলৌকিক জগৎ নিয়ে বিশ্বাস ছিল বেশ বিস্তৃত। মরণের পার থেকে কেউ যাতে ফিরে এসে গোল না বাধায়, তার জন্য ভিক্টোরীয়রা বেশ কিছু সংস্কার মানতেন।
মৃতদেহ বাড়ি থেকে বার করার সময় তাঁরা মৃতের পা আগে বার করতেন, যাতে মৃত ব্যক্তির আত্মা ফিরে তাকাতে না পারে বা তার সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে না পারে।
পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মৃতের বাড়ির সমস্ত আয়না কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলা হত। কারণ ভিক্টোরীয় সমাজ বিশ্বাস করত যে, মৃতের আত্মা আয়নার ভিতর ঢুকে পড়তে পারে। এবং তেমন ঘটলে মহাবিপদ হবে।
কেউ মারা গেলে পরিবারে দুর্ভাগ্য নেমে আসতে পারে, এই বিশ্বাস থেকে ভিক্টোরীয়রা বাড়ির সব ক’টি ঘড়ির কাঁটা প্রয়াত ব্যক্তির মৃত্যুর সময়ে নিয়ে গিয়ে ঘড়ি বন্ধ করে রেখে দিতেন। পারলৌকিক কাজ না হওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থা চলত।
মৃতের আত্মা যাতে উপদ্রব না করতে পারে, তাই মৃত ব্যক্তির সমস্ত ছবি উল্টো করে রাখা হত যত দিন না পর্যন্ত পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয়।
ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডেই আবিষ্কৃত হয় দাগেরোটাইপ ফোটোগ্রাফি। এই পদ্ধতিতে বহনযোগ্য ক্যামেরায় ছবি তোলা সম্ভব হয়ে উঠলে মৃত ব্যক্তির ছবি তোলার চল শুরু হয়। অনেকেই মৃত্যুকে জীবনের সব থেকে বড় ঘটনা হিসাবে মনে করতেন বলেই মৃত ব্যক্তির ছবি তোলার বিষয়টি প্রায় প্রথায় পরিণত হয় সেই সময়। তা ছাড়া, অনেকেরই জীবদ্দশায় ছবি তোলা হয়ে উঠত না। তাঁদের মৃতদেহের ছবি তুলেই পরিজন স্মৃতি সংরক্ষণ করতেন। এই ছবি তোলার বিষয়টি ‘পোস্টমর্টেম ফোটোগ্রাফি’ বা ‘ডেথ ফোটোগ্রাফি’ নামে পরিচিত ছিল।
ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে শিশুমৃত্যুর হার ছিল উল্লেখযোগ্য রকমের বেশি। অকালপ্রয়াত শিশুদের মৃত অবস্থার ছবি তোলা তখন রেওয়াজে পরিণত হয়। অনেক সময়ে শিশুদের মৃতদেহকে ভাল পোশাক পরিয়ে জীবিত মানুষের মতো বসিয়ে ছবি তোলা হত। এমন সুসজ্জিত মৃতদেহের ছবি প্রাপ্তবয়স্কদেরও তোলা হত। ‘ডেথ ফোটোগ্রাফি’-র চল সাগর পেরিয়ে আমেরিকাতেও শুরু হয়। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়েও চালু ছিল এই ভিক্টোরীয় ‘প্রথা’।
ভিক্টোরীয় যুগে সমাধি ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। সমাধিক্ষেত্রগুলিতে শিল্পসুষমামণ্ডিত স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য শুধু ইংল্যান্ড নয়, আমেরিকা এমনকি ভারতের মতো উপনিবেশগুলিতেও দেখা দিতে শুরু করে। কলকাতার পুরনো কবরখানাগুলিতে আজও দেখতে পাওয়া যায় এমন স্থাপত্য-ভাস্কর্য।
ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে সাধারণ ভাবেই মৃত্যুহার ছিল বেশ বেশি। পরিবারে মৃত্যু ছিল এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু ভিক্টোরীয়রা মৃত্যুকে উদ্যাপন করতে শুরু করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান উপন্যাসে, কাব্যে মৃত্যু একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে। মনে রাখা দরকার, ভিক্টোরীয় যুগ ছিল একাধারে রোম্যান্টিক শিল্প-সাহিত্যের উত্থানের কাল এবং ভয় ও রহস্য সাহিত্যেরও উড়ান-সময়। মৃত্যু এই যুগে কখনও দেখা দিয়েছে প্রিয়জনের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ রূপে, কখনও বা তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয় ও রহস্যের সূত্রপাত। আজও ভিক্টোরীয় যুগের মৃত্যুভাবনা ইতিহাস বা সমাজবিদ্যার গবেষক ও সাহিত্যিকদের কাছে কৌতূহলের বিষয়।