ভারতের দক্ষিণ, পশ্চিম এবং পূর্বের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে জল, এক দিকে পাহাড়। তাই ভারতের তিন দিক জুড়ে রয়েছে প্রচুর বন্দর। বাণিজ্যের দিক থেকে এই বন্দরগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভারতের জন্য নয়, অন্য দেশগুলির জন্যও ভারতীয় বন্দরগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। সেই বন্দরের তালিকায় যোগ হতে চলেছে মহারাষ্ট্রের বধাবন বন্দর।
তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে দিল্লির গদিতে বসেছেন নরেন্দ্র মোদী। সরকার গঠনের পরই দেশের একাধিক প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছে মোদীর মন্ত্রিসভা। তার মধ্যে আছে মহারাষ্ট্রের এই বন্দর প্রকল্প।
বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার বধাবনে ৭৬ হাজার ২০০ কোটি টাকায় সব ঋতুতে ব্যবহারোগ্য ‘গ্রিনফিল্ড ডিপ ড্রাফ্ট বন্দর’ নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন, প্রকল্পটি যথাক্রমে ৭৪ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ অংশীদারির ভিত্তিতে জওহরলাল নেহরু বন্দর কর্তৃপক্ষ (জেএনপিএ) এবং মহারাষ্ট্র মেরিটাইম বোর্ড (এমএমবি) দ্বারা নির্মিত হবে। এই বন্দর ভারতের বৃহত্তম বন্দর প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হবে।
অশ্বিনী বলেন, ‘‘ন’টি টার্মিনাল বিশিষ্ট ওই বন্দর বিশ্বের প্রথম ১০টির তালিকায় আসবে। এই প্রকল্পে ১২ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে।’’ এই বন্দর প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পরে মোদীও এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে বিষয়টি সকলের নজরে এনেছেন।
মোদী তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের বধাবনে একটি বড় বন্দর তৈরির বিষয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এই বন্দর।’’
ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ করিডর এবং আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডরের জন্য একটি গেটওয়ে বন্দর হিসাবে কাজ করবে এই বধাবন বন্দর। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির ভিত্তিতে এই বন্দরের মূল অবকাঠামো, টার্মিনাল এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি হবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বন্দর এবং জাতীয় সড়কের মধ্যে একটি বড় রাস্তা তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। বন্দর তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ওই রাস্তাও তৈরি হবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বন্দর এবং জাতীয় সড়কের মধ্যে একটি বড় রাস্তা তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। বন্দর তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ওই রাস্তাও তৈরি হবে।
শুধু সড়কপথে নয়, রেলপথেও বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। একটি মালবাহী রেললাইনও তৈরির করা হচ্ছে। রেল মন্ত্রককে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, এই প্রকল্পে সরকার ৩৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। বাকি টাকা বেসরকারি কোনও সংস্থা থেকে নিতে চায় মোদী সরকার। সেই কারণে নিলামও করা হবে।
প্রকল্পটি অনেক আগেই বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। তবে পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে প্রকল্পটি পিছিয়ে যায়। বিশেষত, স্থানীয় বাসিন্দারা পথে নামেন।
গত ২৫ বছর ধরে বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাই কোর্ট স্থানীয়দের আবেদন খারিজ করে দেয়। বর্তমানে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন।
এই এলাকায় স্থায়ী বন্দর ছিল না কোনও দিনই। বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয়দের কথায়, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখানে একটি সংস্থা তৈরি হয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণে কয়লা। ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আসত। বড় বড় জাহাজে করে টন টন কয়লা বধাবন গ্রামে আসত।
সেই জাহাজগুলি বধাবন উপকূলের খুব কাছাকাছি এলেও মূল উপকূল থেকে ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরেই থাকতে বাধ্য হত। সেই থেকে বধাবন বন্দর তৈরির ভাবনা শুরু করে সরকার।
তবে সেই ভাবনার কথা জানাজানি হতেই ক্ষোভ শুরু হয় স্থানীয়দের মধ্যে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন নারায়ণ পাতিল নামে এক ৭০ বছরের বৃদ্ধ। বিক্ষোভকারীদের আপত্তির কারণ ছিল, ওই এলাকায় বন্দর তৈরি হলে সমুদ্রের গতিপথে বড় বাধার সৃষ্টি হবে। ফলে তা পথ ঘুরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়তে পারে।
শুধু তা-ই নয়, ওই এলাকার মানুষদের মূল জীবিকা ছিল মাছ ধরা। লাখ লাখ মানুষ মাছ ধরে জীবন অতিবাহিত করতেন। বন্দর তৈরি হলে সেই পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল।
সরকার বার বার গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মেটানোর চেষ্টা করেছে। আশ্বস্ত করা হয়, বন্দর তৈরি হলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। বরং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। এখন স্থানীয়েরা কিছুটা হলেও আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসেছেন। সেই পরিস্থিতিতেই সরকার নতুন বন্দর তৈরির অনুমোদন দিয়েছে।
ঘটনাচক্রে, আগামী চার মাসের মধ্যেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা। এই প্রকল্প ভোটের আগে সরকারের একটা কৌশল বলেও মনে করছেন রাজনীতিবিদেরা। তবে কবে এই বন্দর তৈরি হয়ে চালু হবে, তার আভাস সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হয়নি।