বৃহস্পতিবার শীতের বিকেলে বাইরে যখন আলো প্রায় পড়ন্ত তখনই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম ঝলমলিয়ে উঠল আলোয়। তবে বিদ্যুতের আলো নয়। এই আলো আসলে অনেক আলোকবৃত্ত কাছাকাছি আসার বিচ্ছুরণ। যে আলোকবৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছে এক একজন তারকা। যাঁরা পাশাপাশি এসেছেন ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসবের মঞ্চে।
২০১৯ সালের পর অতিমারির বছরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব হয়নি। ২০২১ সালেও নয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে আগের বছরের চলচ্চিত্র উৎসবের দেরিতে উদ্যাপিত হয়েছিল। তবে সেখানে বলিউডের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল কম। সেই অর্থে ২০১৯ সালের পর আবার স্বমহিমায় কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হল এই ডিসেম্বরে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মঞ্চে যে তারকাদের হাট বসবে তা অনুমেয় ছিলই।
তবে সেই হাটের গ্ল্যামার কতটা ঠিকরে বেরোবে তা বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের মঞ্চে চোখ না রাখলে বোঝা যেত না।
কে না ছিলেন সেখানে— অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, শত্রুঘ্ন সিনহা, মাহেশ ভট্ট থেকে শুরু করে জয়া বচ্চন, রানি মুখোপাধ্যায়, কুমার শানু, অরিজিৎ সিংহের মতো বলিউডের খ্যাতনামী বঙ্গসন্তানেরাও। বাংলা সিনেমা জগতের ব্যক্তিত্বরা তো ছিলেনই। তা ছাড়াও ছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তবে বৃহস্পতিবার ২৮তম চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধন করলেন বাংলার ‘জামাইবাবু’ অমিতাভই।
তিনিই কেন? মঞ্চে উঠে তার জবাব অবশ্য দিলেন বাংলার ‘ধন্যি মেয়ে’ জয়া বচ্চন। তাঁকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়েছিল। তবে ডায়াসে দাঁড়িয়ে জয়া বাংলাতেই বললেন, ‘‘আমি আর কী বলব, বলবেন তো উনি, যিনি তিন বছর ধরে না বলা সব কথা বুকে পেটে ভরে এনেছেন।... জামাইয়ের সামনে মেয়ের দাম অনেক কম।’’
কয়েকটি সারিতে চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে বসেছিলেন সব তারকা। একেবারে প্রথম সারির মাঝখানের আসনটি ছিল মমতার। তাঁর এক পাশে রাজ্যপাল বোস, অমিতাভ, জয়া, সৌরভ, মহেশ ভট্ট। অন্য পাশে শাহরুখ, রানি, শত্রুঘ্ন, কুমার শানু।
অনুষ্ঠানের শুরু উদ্বোধনী নৃত্যানুষ্ঠানে। যার পরিকল্পনা করেছেন মমতা নিজেই। নেপথ্যে স্তোত্রপাঠ অমিতাভের। বন্দিশে উস্তাদ রাশিদ খান। নৃত্য পরিকল্পক ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় এবং গান গেয়েছেন বাংলার খ্যাতনামী শিল্পীরা।
উদ্বোধনী নৃত্যের পর একে একে অতিথিদের সম্বর্ধনা জানিয়ে বরণ করে নেন বাংলার চলচ্চিত্র জগতের শিল্পীরা। এর পর প্রদীপ জ্বালিয়ে কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবের সূচনা অমিতাভের হাতে। থালি গার্ল ছিলেন অভিনেত্রী রুক্মিনী।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন বাংলার বিধায়ক জুন মালিয়া এবং অভিনেতা সাহেব চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান এগোয় কিফ অর্থাৎ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসবের মঞ্চের উদ্বোধনে আসা অতিথিদের বক্তৃতায়।
বাংলার ‘মহারাজ’ সৌরভ এসেছিলেন নীল রঙের বন্ধগলা স্যুট পরে। বক্তৃতার মঞ্চে উঠে অমিতাভকে তাঁর ৮০ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ক্রিকেটের সেঞ্চুরির তুলনা টানলেন মহারাজ। শাহরুখকে তাঁর আসন্ন ছবি পাঠানের জন্যও শুভকামনা জানালেন। সৌরভ বললেন, ‘‘বাংলার মাটি দীর্ঘ সময় ধরে বহু কিংবদন্তী তৈরি করে এসেছে। যার জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি।’’
বাংলার ধন্যি মেয়ে জয়া তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন মুখ্যমন্ত্রীকে ‘‘আমার প্রিয় বোন মমতা’’ বলে সম্বোধন করে। তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললেন, ‘‘মমতা জানেন উনি যখনই চাইবেন আমি সঙ্গে আছি।’’ তবে জয়ার বক্তৃতার বাকিটুকু জুড়ে ছিলেন অমিতাভই। বাংলাতেই বললেন, ‘‘কী যে করে জানি না। কখনও হাত ভাঙছে, কখনও পা ভাঙছে। মাথাটা যে ঠিক আছে এই অনেক।’’
শাহরুখ পৌঁছেছিলেন একটু দেরিতে। মমতা নিজে মঞ্চ ছেড়ে তাঁকে আনতে গেলেন। শাহরুখের সঙ্গেই মঞ্চে এলেন রানিও। তবে ‘পাঠান’ একাই ছিনিয়ে নিলেন সমস্ত আলো।
বাংলাতেই বক্তৃতা শুরু করলেন বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। বক্তৃতায় বললেন, রানিকে দিয়ে বাংলা লিখিয়েছি। তাই ভাল হলে আমার ক্রেডিট। খারাপ হলে দায়ী রানি।
এর পর বাংলাতেই বললেন ‘‘কলকাতায় এসে খুব ভাল লাগছে। দিদি, দাদা, কলকাতার জামাইবাবু দ্য গ্রেট শ্রী অমিতাভ বচ্চন আর জয়া আন্টি। এদেরকে আবার এই মঞ্চে দেখে আমার খুব ভাল লাগছে। অনেক দিন দেখা হয়নি তো! আর আমার প্রিয় সুন্দর রানিকে দেখে আমি খুশি। রাজ্যপালকে ধন্যবাদ। কয়েক বছর আসা হয়নি, আপনাদের সবাইকে দেখে সব থেকে খুশি হলাম। সত্যি বলছি।’’
মঞ্চে দাঁড়িয়ে আসন্ন ছবি পাঠানের সংলাপও বললেন অভিনেতা। ‘‘আপনি কুর্সিকি পেটি বাঁধ লিজিয়ে মৌসম বিগড়নে ওয়ালা হ্যায়... ’’
রানির অভিনয় জীবন ২৫ বছরে পড়ল এ বছরই। মঞ্চে উঠে রানি বললেন, ‘‘বাংলাকে আমি মিস করি। এখানে আসতে পেরে ভাল লাগছে। আমার কেরিয়ারের ২৫ বছরে এই সম্মান পেয়েও খুব ভাল লাগছে।’’
অমিতাভ মঞ্চে কথা বললেন বাংলায়। বললেন, ‘‘কলকাতা আমার বাড়ির মতো। আপনাদের জামাইবাবু জীবনভর আপনাদের জামাই থাকবে। ৩ বছর আসতে পারিনি তাই কষ্ট হয়েছে।’’
সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন শত্রুঘ্ন। তাঁর কথা শুরুই হয় তাঁর বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে— খামোশ! এর পর অবশ্য অমিতাভকে ‘ন্যাশনাল আইকন’ এবং শাহরুখকে ‘ন্যাশনাল স্টার’ আখ্যা দেন তিনি।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে হাজির ছিলেন শতাব্দী রায়, দেব, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল, রুক্মিনী মৈত্র, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, রঞ্জিৎ মল্লিক, কাঞ্চন মল্লিক, সোহম চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়, সায়ন্তিকা, তৃণা সাহা, ঋতাভরী চক্রবর্তী, মিমি চক্রবর্তী, পাওলি দাম, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়-সহ টলিউডের অনেকেই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী। তাঁকেও সম্বর্ধনা জানানো হয়।
একেবারে সাধারণ পোশাকে কিফের মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন অরিজিৎ সিংহ। পাঞ্জাবির উপর একটি শাল জড়িয়ে। মঞ্চে তাঁকে গান গাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি ‘বোঝে না সে বোঝে না’ ছবির গান দিয়ে শুরু করে শাহরুখের ‘দিলওয়ালে’র গান ‘রং দে তু মোহে গেরুয়া’ দিয়ে শেষ করেন।
প্রথম সারিতে বসেছিলেন কুমার শানু। তিনি বলেন, ‘‘দিদি যখনই আমাকে ডাকবেন আমি তখনই হাজির হব।’’ মঞ্চে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে ছবির গান গাইলেন শানু।
মহেশ ভট্ট প্রশংসা করেন বাংলার সংস্কৃতির। কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবের পোস্টারে পাশাপাশি চার্লি চ্যাপলিন এবং বাংলার অপুর সহাবস্থানকেও প্রশংসায় ভরিয়ে দেন বলিউডের পরিচালক প্রযোজক মহেশ।
শেষে বক্তৃতা করেন মমতা। রাজ্যপাল বোসকে বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনার এত সময় নিচ্ছি তার জন্য ক্ষমা চাইছি।’’
অমিতাভকে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি শাহরুখকে অভিনন্দন জানান মুখ্যমন্ত্রী। বলেন শাহরুখ আমার ভাই। জয়া, রানি-সহ বাকি অতিথিদেরও আলাদা করে ধন্যবাদ জানান মুখ্যমন্ত্রী।