ফাইল চিত্র
এই ফান্ডের টাকা খাটে ঋণপত্র নির্ভর বিভিন্ন প্রকল্পে। তা সরকারের আনা ট্রেজারি বিল, সরকারি-বেসরকারি বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি হতে পারে।
কত দিনের জন্য টাকা খাটছে, তার উপর ফান্ডের রিটার্ন নির্ভর করে। আবার সরকার নাকি কোনও বেসরকারি সংস্থা ওই বন্ড বা ডিবেঞ্চার ছাড়ছে, তার উপরে নির্ভর করে ঝুঁকি।
ঝুঁকির মাত্রা
অনেকে মনে করেন ডেট ফান্ড মানেই ঝুঁকি নেই। তা কিন্তু নয়। বরং বলা যায় এতে ঝুঁকি সরাসরি শেয়ারে লগ্নি করা অথবা ইকুইটি ফান্ডের তুলনায় কম।
যেমন, দীর্ঘ মেয়াদি বন্ডের ক্ষেত্রে (যেমন, ১০ বছর) অনেক বেশি দিন ধরে দামের ওঠা-পড়া চলে। তাই তাতে লগ্নি করা ফান্ডের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। আবার কম সময়ের মধ্যে বন্ডের সুদ ও সেই সঙ্গে দাম বাড়া-কমার সম্ভাবনা কম। তাই স্বল্প মেয়াদের কথা ভেবে আনা লিকুইড বা শর্ট টার্মের মতো ফান্ডে সুরক্ষা বেশি।
তেমনই মূল্যায়ন সংস্থাগুলি বিভিন্ন বন্ডকে রেটিং দেয়। রেটিং খারাপ হলে ঝুঁকি বেশি। ভাল হলে ঝুঁকি কম। অর্থাৎ, রেটিং দেখলেও ঝুঁকির আন্দাজ মেলে।
রকমফের
বাজারে ডেট ফান্ডের সংখ্যা কম নয়। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কোন কোন ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে টাকা ঢালা হচ্ছে, সেগুলির মেয়াদ কত দিনের, লগ্নির জন্য ফান্ড সংস্থা কী পদ্ধতি মেনে চলছে— এই সবের উপর নির্ভর করে ফান্ডও আলাদা আলাদা হয়।
ইস্যুকারীর ভিত্তিতে
কেন্দ্রীয় সরকার, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা বাজারে বন্ড ছাড়ে। এ ছাড়াও রয়েছে ট্রেজারি বিল, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি।
কোন ডেট ফান্ড তহবিলের টাকা এই ধরনের কোন প্রকল্পে খাটানো হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করা হয় ফান্ডগুলিকে।
গিল্ট ফান্ড
• এরা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি ট্রেজারি বিল এবং সরকারি বন্ডের মতো প্রকল্পেই টাকা খাটায়।
• সরকারি প্রকল্পে টাকা রাখায় এর লগ্নি ফেরতের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাৎ সুরক্ষা বেশি।
• অধিকাংশ ক্ষেত্রে গিল্ট ফান্ড দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পে টাকা রাখে। ফলে এই ফান্ডের রিটার্ন সুদের হারের উপরে বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল।
কর্পোরেট বন্ড ফান্ড
• টাকা লগ্নি হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থার ইস্যু করা ডেট সিকিউরিটি বা বন্ডে।
• এই সব সিকিউরিটিকে মূল্যায়ন সংস্থা যে রেটিং দেয়, তা দেখে ঝুঁকির কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
• সরকার বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আনা প্রকল্পগুলিতে সাধারণত টাকা হারানোর সম্ভাবনা খুব কম। সেই তুলনায় বেসরকারি সংস্থাগুলির প্রকল্পে ঝুঁকি বেশি হয়। যে-কারণে লগ্নিকারী টানতে বেশি সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এই সব সংস্থা।
মেয়াদ অনুযায়ী
খুব কম সময়ের জন্য (সাধারণত ১০-১৫ দিন থেকে এক বছরের মধ্যে) টাকা রাখতে চাইলে, বেশ কিছু ফান্ড রয়েছে। যেমন—
লিকুইড ফান্ড
• এই ধরনের ফান্ডের টাকা খাটে শুধুমাত্র স্বল্প মেয়াদি ডেট সিকিউরিটিতে।
• সিকিউরিটির মেয়াদ হতে পারে ৯১ দিন পর্যন্ত। তবে বেশির ভাগ ফান্ড ম্যানেজারই বাজারের ঝুঁকি ও ঝামেলা এড়াতে লিকুইড ফান্ডের মেয়াদ ধরে রাখেন ৬০ দিনের মধ্যে।
• চাইলেই কম সময়ের মধ্যে টাকা তোলা যায়। যেমন, সকালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন জানালে সেই দিনই টাকা ফেরতের সুযোগ দেয় বেশ কিছু সংস্থা। তার পরে আর্জি জানালে টাকা আসে পরের দিন।
• যেহেতু মেয়াদ হয় খুব কম দিন, তাই সুদের হেরফেরের খুব বেশি প্রভাব এই ফান্ডে পড়ে না। যে কারণে সব ধরনের ফান্ডের মধ্যে এদের ঝুঁকি সবচেয়ে কম। ফলে যাঁরা খুব কম সময়ের (ধরুন দিন ১৫-২০) জন্য ফান্ডে টাকা রাখতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ।
• এগুলি মানি মার্কেট স্কিম নামেও পরিচিত।
শর্ট টাম ফান্ড
• লিকুইড ফান্ডের মতোই স্বল্প মেয়াদি ডেট সিজিউরিটি অথবা মূলধনী বাজারে (মানি মার্কেট) লগ্নি করা হয় এই ফান্ডের তহবিল। সাধারণত সেই প্রকল্পগুলির মেয়াদ হয় ৩৬৫ দিনের মধ্যে।
• শর্ট টার্ম প্ল্যানের মতো কিছু ফান্ড আবার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পে মিলিয়ে-মিশিয়ে লগ্নি করে।
• এক মাসের বেশি অথচ এক বছরের কম সময়ে টাকা রাখতে চাইলে বেছে নেওয়া যায় এই ধরনের ফান্ড।
লং টার্ম ফান্ড
• দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন বন্ড বা অন্যান্য ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে লগ্নি করে এই ডেট ফান্ড।
• গিল্ট বা ইনকাম ফান্ড এই তালিকায় পড়ে।
লগ্নির পরিকল্পনা অনুসারে
কোথায় কোথায় টাকা ঢালা হচ্ছে, সেই অনুসারে ভাগ করা ফান্ডগুলির মধ্যে রয়েছে—
ইনকাম ফান্ড
• এই ধরনের ফান্ড লগ্নি করে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন সিকিউরিটিতে। তা সে কর্পোরেট বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদি হতে পারে।
• কর্পোরেট বন্ডে টাকা রাখে বলে এতে ঝুঁকি বেশি।
ডাইনামিক ডেট ফান্ড
• ঋণপত্র নির্ভর সব ধরনের প্রকল্পেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টাকা রাখতে পারে। কোনও নির্দিষ্ট সংস্থা, প্রকল্প অথবা মেয়াদের উপর নির্ভর করে না।
• এটি পরিচালনায় ফান্ড ম্যানেজারের ভূমিকা বেশি।
ফিক্সড ম্যাচিওরিটি
• কোনও ডেট ফান্ড যে যে প্রকল্পে টাকা রাখছে, সেগুলির মেয়াদের উপরেই সংশ্লিষ্ট ফান্ডের মেয়াদ নির্ভর করে।
• নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকার অর্থ, এটি ক্লোজ এন্ডেড ফান্ড। ফলে নিউ ফান্ড অফারের পরে আর এতে সরাসরি লগ্নি করা যায় না।
• এক বার প্রকল্প বাছাই হয়ে যাওয়ার পরে ফান্ড ম্যানেজারের খুব একটা ভূমিকা থাকে না।
ফ্লোটিং রেট ফান্ড
• কিছু কিছু ঋণপত্র রয়েছে, যেগুলিতে সুদের হার বাজারের ওঠা-পড়ার সঙ্গে বদলায়। সেই সব প্রকল্পেই টাকা খাটায় এই ফান্ড।
জাঙ্ক বন্ড স্কিম
• যে-সব সংস্থার ঋণপত্রের রেটিং সব থেকে খারাপ, বেছে বেছে সেগুলিতেই লগ্নি করে এই ফান্ড। ফলে এতে লগ্নি করা টাকা ফেরত না-আসার আশঙ্কা থাকে।
• ফান্ডের নজর থাকে সংস্থাগুলির আকর্ষণীয় রিটার্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির উপরে। যাতে কোনও একটি সংস্থা টাকা ফেরাতে না-পারলেও, অন্যগুলি তা পুষিয়ে দেয়।
• এই ধরনের ফান্ডে ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
• ভারতে জনপ্রিয় না-হলেও, বিদেশে প্রচলন বেশি।
হাইব্রিড বা মিশ্র ফান্ড
শেয়ার ও ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে মিলিয়ে-মিশিয়ে লগ্নি করে এই ফান্ড। কিছু ফান্ড আবার টাকা রাখে সোনাতেও। শেয়ারে টাকা খাটিয়ে রিটার্ন বাড়ানো এবং ঋণপত্রে লগ্নির মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখাই এই ধরনের ফান্ডের লক্ষ্য।
এ ক্ষেত্রেও ঝুঁকি ও রিটার্ন নির্ভর করে কোথায় ফান্ড টাকা রাখছে, তার উপর। শেয়ারে বেশি টাকা রাখলে ঝুঁকি যেমন বেশি, তেমনই আবার কোনও সংস্থার খারাপ রেটিংয়ের ঋণপত্রে টাকা খাটলেও তা বেশি।
সংসারের সদস্য
ডেট ফান্ডের মতোই হাইব্রিড ফান্ডেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প রয়েছে—
ডেট ওরিয়েন্টেড
• এই ফান্ডের টাকা খাটে মূলত ঋণপত্রে। সাধারণত সর্বোচ্চ ৩০% টাকা শেয়ারে লগ্নি হয়। কোথায় কত টাকা লগ্নি হবে, তা অফার ডকুমেন্টে লেখা থাকে।
• মান্থলি ইনকাম ফান্ডের মতো ডেট ওরিয়েন্টেড হাইব্রিড ফান্ডগুলি সাধারণ ভাবে প্রতি মাসে ডিভিডেন্ড দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। কিন্তু প্রতি মাসেই যে তা দেওয়া হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ফলে শুধু ডিভিডেন্ডের ভরসায় এতে লগ্নি না-করাই উচিত।
ইকুইটি ওরিয়েন্টেড ফান্ড (ব্যালান্সড ফান্ড)
• এদের বেশির ভাগ টাকা লগ্নি হয় শেয়ারে। ঝুঁকি কমাতে কিছুটা আবার রাখা থাকে ঋণপত্রে।
• এই ধরনের ফান্ডে এমনিতে নিয়ম মেনে তহবিলের টাকার ৬৫% শেয়ারে লগ্নি করা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সংস্থাগুলি তহবিলের ৮৫% টাকাই শেয়ারে ঢালে। ফলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
• যাঁরা ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন এবং বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের সাবধান থাকা উচিত। যে-কারণে লগ্নির আগে অবশ্যই অফার ডকুমেন্ট খুঁটিয়ে পড়ে নিতে হবে।
ক্যাপিটাল প্রোটেক্টেড
• ফান্ড তহবিলের বেশির ভাগটা খাটানো হয় সরকারি সিকিউরিটিতে। নিশ্চিত করা হয়, যাতে নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে লগ্নি করা টাকার পুরোটাই ঘরে ফেরে। আর বাদবাকি অংশ যায় শেয়ার বাজারের মতো বেশি ঝুঁকির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। লক্ষ্য বাড়তি রিটার্নের ব্যবস্থা করা।
• এই ফান্ডে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত টাকা রাখতেই হয়।
অতএব...
নিজের পছন্দের ফান্ড বাছাইয়ের সময়ে সব দিক বিচার করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।
আয়ের সূত্র
কোনও ডেট ফান্ড টাকা খাটায় বন্ড বা ঋণপত্রে। বন্ডে লগ্নি করলে, তিন ভাবে আয় হয়—
• তার থেকে প্রাপ্য ‘সুদ’। বন্ডের বাজারে যা কুপন হিসেবে পরিচিত। ধরুন, ১০০ টাকা দামের বন্ড বছরে ১০ টাকা সুদ দিলে, তার কুপন ১০%। সাধারণত এই হার পুরো মেয়াদে একই থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে তা পরিবর্তনশীল হতে পারে।
• ওই কুপন না-তুললে, তা ফের বন্ডেই লগ্নি হয়।
তা কুপনের উপরি সুদ। মানে, প্রথম বছরে কুপন হিসেবে পাওয়া ওই ১০ টাকার উপরেও দ্বিতীয় বছরে তার ১০% (১ টাকা) সুদ পাওয়া যাবে।
• বাজারে বন্ডের দর ওঠা-নামা করে। ফলে ১০০ টাকায় কেনা বন্ড ১০৫ টাকায় বেচতে পারলে, তা থেকেও ৫ টাকা মুনাফা ঘরে তোলা সম্ভব।
এই তিন ধরনের প্রাপ্তি মিলিয়ে যে-মুনাফা হাতে আসে, তা মোট বিনিয়োগের অনুপাতে কতখানি, সহজ কথায় তা-ই হল ওই বন্ডের ইল্ড।
এ বার যে বন্ড বা সিকিউরিটিতে আপনার ফান্ড প্রকল্প লগ্নি করছে, তা থেকে পাওয়া সুদ ও দামের উপরেই সেই ফান্ডের রিটার্ন নির্ভর করবে। অর্থাৎ, সেটিই তার আয়ের সূত্র।
আর যেহেতু বন্ডের আয় বদলাতে থাকে, তাই ডেট ফান্ডেও নির্দিষ্ট রিটার্ন মিলবে এমন নয়।