সব ভুলে যাই তাও ভুলি না

কুমিল্লার কোলে বড় হয়ে ওঠা শচীনদেবের গল্পতখন সবে ক্লাস নাইন। বন্ধু-স্যাঙাতদের নিয়ে কিশোর শচীন গেছে কমলাসাগরে পুজোর মেলায়। মেলা বসেছে কুমিল্লার বাড়ি থেকে মাইল দশ দূরে। ফিরতি পথে মহা বিপত্তি! বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে, ধরা পড়ে সোজা স্টেশনমাস্টারের গুদামে বন্দি! আসলে মেলা দেখতে গিয়ে দেরি হল খুব। হুড়মুড়িয়ে স্টেশনে এসে দেখে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। তখন আর টিকিট কাটার সময় কই! মেলায় আসার কথা ঘুণাক্ষরে জানে না কেউ। এ বার জানাজানি হলে রক্ষে নেই। অগত্যা, ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনে ওঠা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ছবি: পরিমল গোস্বামী

তখন সবে ক্লাস নাইন।
বন্ধু-স্যাঙাতদের নিয়ে কিশোর শচীন গেছে কমলাসাগরে পুজোর মেলায়। মেলা বসেছে কুমিল্লার বাড়ি থেকে মাইল দশ দূরে।
ফিরতি পথে মহা বিপত্তি! বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে, ধরা পড়ে সোজা স্টেশনমাস্টারের গুদামে বন্দি!
আসলে মেলা দেখতে গিয়ে দেরি হল খুব। হুড়মুড়িয়ে স্টেশনে এসে দেখে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। তখন আর টিকিট কাটার সময় কই!
মেলায় আসার কথা ঘুণাক্ষরে জানে না কেউ। এ বার জানাজানি হলে রক্ষে নেই। অগত্যা, ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনে ওঠা।
কিন্তু এ তো অন্য গেরো! কেলেঙ্কারির এক শেষ! ভয়ে কেঁদেই ফেলল শচীন।
শেষে বন্ধু মোহিত বুদ্ধি দিল, ‘‘শোন, স্টেশনমাস্টারের মা খুব গান ভালবাসেন। কিছু দিন আগে আমাদের বাড়িতে ঢপ কীর্তন শুনতে এসেছিলেন। তখন দেখেছিলাম, গান শুনছেন আর কাঁদছেন। এক কাজ কর, তুই তোর ভাটিয়ালি, বাউল গান গুলো গা তো দেখি। তাতে যদি কিছু হয়।’’
যা থাকে কপালে বলে, বন্ধ গুদামঘরে বসেই গান ধরল শচীন।
ওমা, তাতেই কাজ হল!
দশ মিনিটের মধ্যেই গুদামঘরের দরজা খুলে দাঁড়ালেন স্টেশনমাস্টারের মা!
মুক্তি তো হলই, সঙ্গে ফেরার পথে মিষ্টি মুখও।

Advertisement

•••

Advertisement

গান পেলে শচীন সেই ছোট্টবেলা থেকেই পাগলপারা। তার গানে অন্যরাও তাই।

এ দিকে কিন্তু ত্রিপুরার রাজবাড়ির ছেলে। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র রাজা হননি বটে, কিন্তু মহারাজকুমার তো! মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের একমাত্র বংশধর। বিলাস, প্রাচুর্য কম ছিল না বাড়িতে। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল কড়া নজর, শাসন— প্রজাগজাদের সঙ্গে মেলামেশা চলবে না। শচীন কোনও কালেই ওসব তোয়াক্কা করেনি। তাতে তার বাবার যে ভ্রূক্ষেপ ছিল, তাও না।

ত্রিপুরার রাজ-সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্বে নবদ্বীপচন্দ্রকে ব্রিটিশ-অধিকৃত (ত্রিপুরার জমিদারি) কুমিল্লাতে নির্বাসিত হতে হয়। নবদ্বীপ সেতার বাজাতেন। তাঁর ধ্রুপদ গানের গলাও ছিল চমৎকার। ছবি আঁকতেন, মূর্তি গড়তেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব। কবি যখন ত্রিপুরায় আসেন তখন তিনি তাঁর কাছে ছিলেন বেশ কয়েক দিন। বাবারই ধাঁচ পেয়েছিল ছেলে শচীন।

ভাইবোনেদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শচীনের জন্য নবদ্বীপেরও ছিল প্রবল টান। অন্য ছেলেদের দার্জিলিং-এ বোর্ডিং স্কুলে রেখে পড়শোনা করালেও শচীনকে তিনি বহু কাল কাছছাড়া করতে পারেননি। বাবা নবদ্বীপ, মা নিরুপমার আদর তো ছিলই, পাশাপাশি তাকে আহ্লাদে রাখার জন্য আর ছিল ‘রবির মা’। ছোট্ট শচীনের ধাই-মা। খুব ফর্সা ছিল বলে ধাই-মা শচীনকে ডাকত ডালিমকুমার!

শিশুবেলায় শচীনের গানে মজে যাওয়ার শুরু তার ছোড়দার কাছে। ছ’বছরের বড় ছোড়দা কিরণকুমার ছিলেন লেফটেনেন্ট কর্ণেল। বাবার ইচ্ছেয় তাঁকে মিলিটারিতে যেতে হয়, কিন্তু বরাবর তাঁর মন ছিল ললিতকলায় ভরপুর। খুবই অল্প বয়েসে তাঁর মৃত্যু হয়। মেজদি তিলোত্তমাদেবীও ভাল গান জানতেন। তবে এঁরা কেউ নন, মার্গসঙ্গীতে শচীনের প্রথম গুরু নবদ্বীপচন্দ্র।

ইস্কুলে সরস্বতী পুজোয় বাবার শেখানো গান গেয়ে শচীন প্রথম বারের মতো বন্ধুদের মধ্যে ‘হিরো’ হয়ে যায়। তার গান হেডমাস্টারমশাইয়েরও এত ভাল লাগে যে, তিনি তারিফ করে পেল্লাই একটা চিঠিও লিখে পাঠান নবদ্বীপচন্দ্রকে।

কুমিল্লায় তখন ধ্রুপদ-গাইয়ে হিসেবে শ্যামাচরণ দত্তর খুব নামডাক। কিন্তু শচীনের গান শেখা বাবার কাছেই চলছিল।

আর ছিল মাধব আর আনোয়ার।

মাধব বাড়ির বৃদ্ধ নোকর। ছুটির দিনে দুপুরে মাধব সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনাত। তার সরল সোজা তান শচীনকে মায়ায় ভ’রে দিত।

আনোয়ার আরেক নোকর। সে ছিল শচীনের মাছ ধরা শেখানোর গুরু। বাগানের বাঁশ কেটে ছিপ তৈরি করে দিত আনোয়ার। বাড়িতেই তো পুকুর। সে প্রায় ষাট বিঘে। তাতেই দু’জনে মিলে মাছ ধরা চলত। রাতে দোতারা বাজিয়ে আনোয়ার ভাটিয়ালি গাইত। তার মিঠে সুরে শচীনের পড়া উঠত মাথায়। যে জন্য কত বার মাস্টারের বকুনি খেয়েছে! তবু গানের কুলায় যার বাসা, সে কি আর গান ছাড়তে পারে!

ইস্কুল তো বটেই, কলেজে পড়ার সময়ও সেই গান আর গান। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তে গিয়ে খোঁজ পেল পাশেই নবাব বাড়িতে বড় বড় গাইয়ে, বাজিয়ে, বাঈজিরা এসে আসর বসান। পড়ায় ফাঁকি দিয়ে রাত জেগে নবাববাড়ির বকুলতলায় লুকিয়ে বসে গান শোনা ছিল বাঁধা। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাটিয়ালি, বাউল, ফকির, বোষ্টমদের ডেরায় যাওয়া তো ছিলই। তাঁদের সঙ্গে এক হুকোয় তামাকুসেবনও।

গান গাওয়া, গান শোনা, গানের জন্য ছুটে বেড়ানো আর মাছ ধরা। এর বাইরে আর যা ছিল, তা হল টেনিস। কুমিল্লার বাড়িতে বিশাল লন। সেখানে প্রায়ই চলত র‌্যাকেট হাতে দৌড়ঝাঁপ। এলাকায় ‘টেনিসচ্যাম্পিয়ন’-এর খ্যাতি তখন থেকেই। তখন কে আর জানত তার এ-খেলায় এক দিন তাঁর সঙ্গী হবেন অভিনেতা গুরু দত্তও!

আইএ পাস হল। দাদারা তখন বিদেশে। শচীন চাইল এ বার কলকাতা যাবে। আসলে কলকাতা গিয়ে গান শেখার ইচ্ছেটা তখন যে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

বাবা রাজি হলেন না। বললেন, ‘‘তুমি আমার ছোট ছেলে। অন্যরা বিদেশে। আমি চাই অন্তত দুটো বছর তুমি আমার কাছে থাকো।’

বিএ পড়া শুরু। আর সেই সঙ্গে নতুন উদ্যমে চলল গান-অভিযান। পুববাংলায় এমন কোনও নদী নেই যেখানে যাওয়া হয়নি যুবক শচীনের। বিএ পাশ করার পর বাবা-ই নিজে ছেলেকে কলকাতায় এনে ইংরেজি এমএ ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন!

রাজবাড়ির তনয় শচীনদেব বর্মনের জীবন শুরু হল শহর কলকাতায়। ঠিকানা, ত্রিপুরা প্যালেস!

সূত্র: শরগমের নিখাদ (শচীনদেব বর্মন)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement