১৯ মে ১৯৯৭। সিরিটি শ্মশানে জনমানব নেই। রাত্রি এগোচ্ছে দিনের আলোর দিকে। আকাশ বলছে, ‘ছাড়ব’ ‘ছাড়ব’। বিদায়ের বাঁশিতে কোমল ধৈবতের সুর।
ভাগ্যদেবীর সন্তান রাজা অয়দিপাউসের মতোই তাঁর সৃষ্টিকে আলোতে বিলীন করে দিলেন শম্ভু মিত্র। তাঁর ইচ্ছে মতো কোনও ফুল নয়, কোনও চন্দনের ফোঁটা নয়, অগুনতি ভক্তের বুক চাপড়ানো আবেগ নয়। বরং একেবারে নির্লিপ্তভাবেই কালো পেড়ে ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবিতে সকলের আড়ালে মৃত্যুর আলোয় মুক্ত হলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের একলা রাজা।
অসম্মান যেন তাঁর চলে যাওয়াকে কোথাও স্পর্শ না করে, তাই আড়াল রেখে আড়াল করেছিলেন নিজেকে। শম্ভু মিত্র তো ম্যাটিনি আইডল ছিলেন না। তিনি নিজেই বলে গেছেন, “আমার যে খুব অবজ্ঞায়-খুব-বিচ্ছিরিভাবে মৃত্যু হবে, এটা প্রায় আমি শিওর।” মৃত্যুর আনন্দকে নিজের মধ্যে ধারণ করে একান্তে চলে যাওয়ার মধ্যে কিন্তু কোনও অভিমান ছিল না। কাঙ্ক্ষিতের সঙ্গে মিলনই ছিল তাঁর দিনান্তের সাধ। লোকে ভাবে মানুষকে অবজ্ঞা করতে চেয়েছিলেন তিনি। মানুষের কী অন্যায় এ ভাবনা! বিরাশি বছর ধরে বেঁচে নিজের লেখায়, কাজে মানুষকেই তো সচেতন করতে চেয়েছিলেন তিনি। দর্শকই ছিল তাঁর সমস্ত শ্রদ্ধার কেন্দ্রে। আসলে নিজের নির্মাণের প্রথম দিন থেকেই মানুষটি স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটেছেন। সেই কারণেই জনতার মাঝে তিনি অপূর্ব একা। যা কিছু আমাদের জানা, চেনা তার বাইরে গিয়ে কেবল নিজেকে বার বার ভেঙেছেন। তাঁর চোখ দিয়েই বাংলা থিয়েটার আনকোরা আধুনিক মেধাকে জানতে পেরেছে। আমার তো মনে হয়, স্থিতি শব্দটা ওঁর অভিধানে ছিলই না।
আচ্ছা সেই শম্ভু মিত্র মানুষটি কোন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মনে করেছিলেন থিয়েটারের রক্তে, গন্ধে, নিঃশ্বাসে নিজের জীবনকে ডুবিয়ে রাখবেন? সময় যেন ইঙ্গিত দিয়ে যায়, শম্ভু মিত্র যখন জন্মালেন গিরিশ ঘোষ নেই। গিরিশ ঘোষকে নিয়ে সমালোচনাও আরম্ভ হয়ে গেছে। তাঁর থিয়েটারে নাকি সকলেই দাঁড়িয়ে থাকে। শয়নকক্ষের কোনও ব্যাপার নেই।
শিশির ভাদুড়ী আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ধ্রুপদী মাধুর্য নিয়ে। শম্ভু মিত্রর সঙ্গে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অভিনয়ের সূত্রপাত ১৯৪০-এ। শম্ভু মিত্র এ প্রসঙ্গে বলছেন, “আমি যখন ওঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি তখন অনেক সময় বাঁধা অভিনয় করেছি। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কো-অ্যাক্টিং-এ কখনও সেই মজাটা পাইনি, যা একটা জ্যান্ত লোকের রই্যাকশনে দেখেছি। উনি কেমন করবেন সে আমার জানা আছে।” সেই শিশির ভাদুড়ীকে দেখতে হল ‘নবান্ন’। দেখতে হল থিয়েটার কেমন করে তাঁর থেকে সরে আসছে। ‘নবান্ন’-র জন্য ‘শ্রীরঙ্গম’ মঞ্চ ছ’দিনের জন্য ভাড়া দিয়ে আর ভাড়া দেননি শিশির ভাদুড়ী। বোধহয়, চাননি আর ‘নবান্ন’ হোক। হয়তো বা নিজের ‘পরাজয়’টা দেখতে চাইছিলেন না বারবার।
একবার যোগেশ চৌধুরীর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে সোজা গ্রিনরুমে চলে গিয়েছিলেন শম্ভুদা। অথচ নাটকটি ছিল খুবই নিম্নমানের। তাও এমন অভিনয় কী করে সম্ভব? জানতে চেয়েছিলেন শম্ভুদা। সরাসরি কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। যোগেশ চৌধুরী কেবল বলেছিলেন, “ধ্যান করো, ধ্যান।” ব্যস, এইটুকুই। তাতে বেজায় চটে গিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। পরে আমায় বলেছিলেন, “তত দিনে বুঝে ফেলেছি, এঁরা কেউই আমায় কিছু শেখাবে না।”
বাল্যে মাতৃহীন হওয়ার পরে শম্ভু মিত্র বড় হয়েছিলেন বাবা শরত্কুমার আর ভাই শঙ্করের সঙ্গে। পিতা শরত্কুমার জমিদার বংশের সন্তান হয়েও কখনই সেই অর্থ বা গরিমা নিয়ে বাঁচেননি। রাশভারী, অন্তর্মুখী এই মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের কোনও অবকাশ ছিল না। ম্যাট্রিকুলেশনে ফল ভাল করলে গলা খাঁকারি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন বাবা। পুত্রর সাফল্য নিয়ে কোনও উচ্ছ্বাসই ছিল না। শুধু কালি আর ফাউন্টেন পেন টেবিলের ওপর রেখে শুধু “ইয়ে...” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
আর এ দিকে শম্ভুদা এত সাফল্যের পরেও বুঝে গিয়েছিলেন, বিদ্যালয়ের পড়াশোনা নয়, থিয়েটার তাঁকে টানছে। শরত্কুমারের কাছে লখনউ এবং ইলাহাবাদে থাকার সময় থেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা আর পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ে নিজেকে তৈরি করার পর্ব চলেছিল। অল্প বয়েসেও খেলাধুলো বা গল্প-আড্ডা এসব তাঁর জীবনে ছিল না। বই ছিল একমাত্র বন্ধু। কেবল নাটকের বই নয়, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, মার্ক্স, ফ্রয়েড, সব পড়া হয়ে গিয়েছিল কুড়িতে পা দেওয়ার আগেই। ফলে এক ধরনের পরিণত মন তৈরি হয়ে গিয়েছিল কম বয়সেই। এই মন তো অন্যভাবে সব কিছুকে বুঝতে চাইবেই। সেই সঙ্গে চলত কবিতা মুখস্থ করা, আবৃত্তি করা।
স্বনির্ভর হতে চলে এলেন কলকাতায়। গলা তৈরির একটা তাগিদ মনের মধ্যে ছিল। টানা দশ-বারো বছর গলা সাধা চলেছিল। বলেছিলেন, “চেঁচিয়ে আবৃত্তি করতুম। বলে দেবার কেউ ছিল না। কিন্তু আমি উঠোনের এক প্রান্তে বলতে আরম্ভ করলুম আর কল্পনা করতে লাগলুম ওই পাশে একজন লোক স্পষ্ট আমার কথা শুনছেন।” বাবার ভয়ে কলেজ কেটে দুপুরে চর্চা করতেন। এই কণ্ঠচর্চার ফল এমন হল যে পাড়ার লোকে বলেছিল ওই বাড়ির ছেলেটাকে নির্ঘাত কুকুরে কামড়েছে! একবার রসিকতা করে শম্ভুদা আমায় বলেছিলেন, “বাড়িতে পোয়াতি-টোয়াতি থাকলে তো এই চিত্কারে গর্ভনাশ হয়ে যাওয়ার কথা।”
মন তো বলছে থিয়েটর করব। কিন্তু কোন থিয়েটার? “সন্তোষবাবু (কথাসাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ) নাটক লিখেছেন, আমার ভাল লাগছে না। বুদ্ধদেববাবু (বসু) নাটক লিখেছেন, আমার ভাল লাগছে না। আমি তো জানি এসব নাটক লোকের খুব ভাল লাগবে। অনেক লোকে মনে করেন যে কেন এগুলো করছি না। আমার মনটা চাচ্ছে না। আমি ইমোশন একটা দেখাতে পারি। ক্লোজ আপ নিলাম, চোখ টলটল করছে। ওটা ওই পর্যন্তই। কিন্তু ওর ভেতরে তিন-চারটে চিন্তা হচ্ছে আমার মাথায়, সেটা কী করে প্রকাশ করব? একটা মেয়ে সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে, হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে, মুখটা শুকনো। তাকে বেশ দুঃখের প্রতীক বলে মনে হয়, এই তো? কিন্তু এতে ভাঙাটা কোথায়?”
ভাঙতে চাওয়ার তাগিদেই কিছু দিন যাত্রা-য় অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র। কালীঘাট বাজার চত্বরে বিপিন গুপ্তের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। যাত্রাকে খাটো করে দেখেননি কিন্তু। বরং যাত্রার মধ্যে অ্যাপিল টু ইন্টেলিজেন্স এই বিষয়টাকে শম্ভু মিত্র গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু শম্ভু মিত্র বুঝতে পেরেছিলেন যারা যাত্রা করছেন তারা বেশির ভাগই যাত্রার লোক নন। যাত্রায় মুড বদল, স্টেপিং-এর কায়দা নিয়ে কেউ তেমন করে চিন্তা করছেন না। বাজনা দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য টাকা খরচা করে যাত্রা, এমনকী থিয়েটারে সংলাপকে লাউড করে দেখানো নিয়ে ওঁর বেশ আপত্তি ছিল। একদিন বললেন, “সমর মরেছে!! বলা মাত্র ঝনঝন বাজনা না বেজে এমনি কথার ওজনে মানুষকে ভারাক্রান্ত করে তোলা যায় না? মিউজিক তৈরি করে কী কাঁচকলার কাজ করেছি আমরা?”
যাত্রা, পাবলিক থিয়েটার কোথাও শম্ভু মিত্রর প্রাণ সাড়া পাচ্ছিল না। কিন্তু ওই প্রত্যেকটার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে উনি নানা দিকপালের সঙ্গ পেয়েছিলেন।
শম্ভু মিত্রর শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব আর অগাধ ভালবাসা কোথাও যদি এক হওয়ার ছিল তো সেটা মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-কে ঘিরে। কোয়ান্টাম থিওরি থেকে দর্শন বুঝিয়ে বলা, স্বদেশি জেল খাটা এই মানুষ, শম্ভু মিত্রকে অবাক করে দিত। আর উনিও জীবনের শেষ পর্যন্ত আগলে রেখেছিলেন তাঁর শম্ভুকে। আসলে মহর্ষি জানতেন এই ছেলেটা যেভাবে থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে আছে, যে মন দিয়ে থিয়েটার চাইছে, তা সচরাচর ঘটে না। অনেক সময়ই এমন হয়েছে মহর্ষিকে শম্ভু মিত্রর প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতের জন্য সমালোচনা শুনতে হয়েছে। তাঁকে তত্ক্ষণাত্ বলতে শুনেছি, “বেশ তো! তোমরা আর একজনকে এনে দাও না দেখি, যে শম্ভুর মত করে থিয়েটারকে ভালবাসবে। আমি তখন তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করব।” গণনাট্য সংঘে শম্ভু মিত্রর কারণেই মহর্ষিকে অপমানিত হতে হয়েছে। গণনাট্য সংঘে শুনেছি মহর্ষি বিরোধীদের বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, এই পথে চললে তো গণনাট্য সংঘ ভেঙে যাবে! তো তখনকার এক নামকরা সদস্যই বলেছিলেন, “যায় যাবে!” সে কথা শুনে শম্ভু মিত্র সেদিনই গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর যাননি।
সেখান থেকেই বহুরূপী-র শুরু। ১৯৪৮ সালে। ‘নবান্ন’ (১৩ সেপ্টম্বর ১৯৪৮ প্রথম মঞ্চস্থ হয়) অভিনয়ের সময়ে চটের পর্দা ব্যবহার করে যে নতুনত্ব আনা হয়েছিল, সেটা মহর্ষির উপদেশেই। এ বার সেই মানুষটিই হঠাত্ চলে গেলেন। ১৯৫৪-র ২১ জানুয়ারি। শম্ভু মিত্রর পিতৃবিয়োগ হল যেন! মহর্ষিকে দেখাতে পারলেন না তাঁর সাধের ‘রক্তকরবী’।
কথায় কথায় বলতেন, “শান্তি বা সুখ কোনওটাই তো দিতে পারলাম না মহর্ষিকে।” শেষ বয়সেও মহর্ষিতে আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। আড্ডাতে প্রায়ই মজা করে বলতেন, “গিয়েই মহর্ষিকে বলব, মহর্ষি এখন কিন্তু আপনি আমার চেয়ে ছোট! আপনি তো ষাট বছরে থেমে গেছেন। আমি এখন আশি।”
এরকম একটা আন্দাজ করা যেতেই পারে তখন কমার্শিয়াল থিয়েটারে থেকে গেলে যুবক শম্ভু মিত্রর প্রাপ্তির ভাণ্ডার অর্থে, খ্যাতিতে ভরে থাকত। কিন্তু তাঁকে সেখানে আটকে রাখার সাধ্য কার?
এ বার মুম্বই চলে গেলেন ছবি করার জন্য। বিজন ভট্টাচার্যের জবানবন্দি নাটকটি হিন্দিতে ‘অন্তিম অভিলাষ’ মঞ্চস্থ হল সেখানে। পৃথ্বীরাজ কপূর নিজে থেকেই চাদর পেতে দাঁড়াতেন অভিনয়ের শেষে। পঞ্চাশের কুখ্যাত মন্বন্তরের জন্য টাকা তোলা হত তখন। চাদর উপচে পড়ত জনতার দানে।
রাজ কপূর একদিন ডেকে পাঠালেন শম্ভু মিত্রকে। সঙ্গে নার্গিস। ‘জাগতে রহো’র স্ক্রিপ্ট শোনা হল। রাজ কপূর বললেন, “আপনি অভিনয় করুন। আমি ছবির পরিচালনা করব।” শম্ভু মিত্র বললেন, “উল্টোটা বরং হোক।” তাই হয়েছিল। পরিচালনা করলেন শম্ভুদা। অভিনয়ে রাজ কপূর। ছবিটা দারুণ জনপ্রিয় হল। লোকে ভেবেছিল এ বার বোধহয় শম্ভুদা বম্বেতে থেকে ছবিই করবেন। মুম্বইতে তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। পি.সি. জোশী শম্ভু মিত্রকে তার দায়িত্ব নিতে বললেন। উনি সোজা না করে দিলেন! বললেন, “বিজন (ভট্টাচার্য) একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট নাটক (নবান্ন) লিখছে সেটা আমাকে করতেই হবে।”
আসলে ফিল্মে সাফল্য এলেও তাঁর খিদে মেটেনি। নিজের মতো করে কিছু করার স্বাধীনতা ফিল্মের মধ্যে তিনি খুঁজে পাননি। এই মানুষকে এক জায়গায় টিকিয়ে রাখা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। যে ‘নবান্ন’-র জন্য মুম্বই ছাড়লেন, সেটা করার সময়ও লোকে প্রথম দিকে শম্ভু মিত্রর দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, “কী সব ধ্যাষ্টামো হচ্ছে।” কিন্তু পরে শম্ভু মিত্র তাঁর পেশাদারি সূক্ষ্মতায় দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেলেন।
১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে শম্ভু আর তৃপ্তি মিত্রর বিয়ে হল। বহুরূপী আর সংসার চলেছিল পাশাপাশি। খুব ছোটবেলা থেকেই শাঁওলীকে নিজের কাজ নিজেকে করতে শিখিয়েছিলেন। একবার মনে আছে, বাড়িতে বহুরূপী-র মহলা চলছে, শম্ভুদার কড়া নির্দেশ, কেউ কোথাও বেরতে পারবে না। সেই আদেশ মানতে গিয়ে তৃপ্তিদি দেখলেন, ছোট্ট শাঁওলী ভাত খেয়ে থালার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
শিল্পী মানেই যে একটা বোহেমিয়ান ভাব থাকবে এই প্রচলিত কথাটা তিনি কিছুতেই মানতেন না। শিল্পী হলে যে সংসারটাকেও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে এমনই একটা মত ছিল শম্ভু মিত্রর। বিদেশে গিয়ে তরকারি কাটার বিভিন্ন রকম কায়দার ছুরি কিনে এনেছিলেন সংসারের জন্য।
হঠাত্ একদিন কী এক খেয়ালে একজন পরিচিত বাসের কন্ডাকটরকে ‘রক্তকরবী’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “ট্রামের কন্ডাক্টর, ছেলেটি বেশ ত্যাঁদড়, তারও বেশ ভাল্লাগল। বলল, রাজা আর নন্দিনীর কথায় রাজার রেগে যাওয়াটা ভাল।”
জানতেন ‘রক্তকরবী’ নামানোটা খুব শক্ত। আজও অনেকে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ বা ‘রক্তকরবী’ করতে চায় না, বলে লোকে নেবে না। অথচ শম্ভু মিত্র ‘রক্তকরবী’-তে চন্দ্রা আর ফাগুলালকে এমন সুরে কথা বলালেন, যে একবার এক রাজমিস্ত্রি মহলা শুনতে শুনতে ওঁকে বলেছিল, “বাবু এরম কথা তো আমরা নিজেরা বলি!” ১০ মে ১৯৫৪ প্রথম ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ হয়।
মনে আসছে ‘ রাজা অয়দিপাউস’-এর সেই দৃশ্য...
রাজা অয়দিপাউস নিজের সৃষ্টির কাহিনিকে আলোতে খুঁজতে চাইছেন। রানি ইয়োকাস্তে তাঁকে বার বার বাধা দিচ্ছেন... অয়দিপাউস বলছেন, “আমি আলো চাই, আলো-ও-ও-ও।” ওইটা বলার সময় ওই যে মাথাটা সামান্য ঝাঁকাতেন, কণ্ঠস্বর উচ্চ হত...উফফ! দর্শক আসনে আমাদের শরীরে বিদ্যুত্ খেলে যেত যেন! এই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনায় বলেছিলেন, “ভ্যাজাইনার আকারে মঞ্চের ব্যাকড্রপ তৈরি হবে!”
৬৪-র নাট্যোত্সবের পরেই মনে হয়েছিল, ‘ব্যস, আর নয়। এবার মঞ্চ থেকে বিদায় নেবার সময় এসেছে।” মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর তখন। এখনই কেন? জানতে চাইলে বললেন, “বুড়ো হয়েছি না! আর কদ্দিন পারা যায়?” ব্যস, ওইটুকুই। ক্রমশ সরে আসতে আসতেও দুস্থ শিল্পীদের জন্য টাকা তুলতে, করলেন ‘দশচক্র’ ও ‘চারঅধ্যায়’। ‘চাঁদবণিকের পালা’ যখন পাঠ করেছিলেন তখন চোখে ভাল দেখতে পান না। তাতেও মজা করে বলতেন, “বাহ্, বেশ চোখ হয়েছে তো, সব সময় মেঘ দেখতে পাই!”
কেউ থিয়েটারকে ভালবেসে কিছু করছে জানলেই শম্ভু মিত্র তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
১৯৭১-এর পরে তিনি আর নতুন কোনও নাটকের নির্দেশনা দেননি। জীবনটাও যেন উথালপাথাল করা ঢেউয়ের মতো তাকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। কালেভদ্রে অভিনয় করেছেন তখন।
তুলসী লাহিড়ী, কালী সরকার, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ অভিজ্ঞ অভিনেতার সমাহারেও বহুরূপী থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। বাংলা নাট্য মঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির’-র স্বপ্ন শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছিল। ‘ক্যালকাটা রেপার্টারি থিয়েটার’ শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তৃপ্তি মিত্র-শম্ভু মিত্রর পথও আলাদা হয়ে গিয়েছিল। না জানি শাঁওলীকে তাঁর জন্য অন্য লোকের কাছে কত কী শুনতে হয়েছে! কিন্তু মানুষটা তো কিছুতেই দমেননি।
শেষ দিকে এক এক সময় বলতেন, “কাউকে কিছু জানাবার জন্য, পরে লোকে চিনবে বলে কিছু রেখে যাওয়ার জন্য কিন্তু থিয়েটার নয়। আমি হয়তো বেশি বুদ্ধিমান হলুম যে, অডিয়েন্স এই আজকের অ্যাক্টিং বুঝতে পারল না। মেনে নিতে হবে। তবে এই নুড়িটা আমি ছুড়ব, ওটা ভবিষ্যতে গিয়ে কোথাও যেন গিয়ে আঁকড়াবে।”
সেই নুড়ি যেন স্পর্শমণি হয়ে আমাদের সকলের জীবনে একমুঠো সকাল এনে দিয়েছে। এরকম এক জীবনকে খুঁজতে খুঁজতে নিজের জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কোনও দিন পথের বিচার করেনি যে মানুষ, কোনও পথের হিসেবও রাখেনি যে মন, সেই মনই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে, ছুটে এসে ফুটে বেরিয়েছে...
ছবি: রানা লোধ।