মাঝে মধ্যে মনে হয়, ভুবন পেরিয়ে এই হিম সন্ধেবেলা, শুধু কবিতার জন্য কি আসা যাবে?
শুধু ভালবাসার জন্য কি হেঁটে যাওয়া যাবে আগুনের ওপর দিয়ে?
প্রতিদিন মরে যেতে যেতেও অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করা যাবে কি?
সুনীলদা পেরেছিলেন। তাঁর সময়টা পেরেছিল। আজকের সময়? সে কি পারবে? নাকি সে আরেক রকমের মুঠোর ম্যাজিকে বিশ্বাসী?
উত্তরটা বোধহয় হিমের আড়ালেই লুকিয়ে। হেমন্তকালের সন্ধেবেলার মিহি চাদরের মতো হিম।
আমরা তো জানি, হেমন্তর পরের স্টপেজ কখনও মান্না, কখনও শীত। তাই চাদর-টুপির জুটিটাকে এড়ানো যাচ্ছে না কিছুতেই। এই নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে একটা বেড়ালের মতো তুলতুলে, নিভৃত ঠান্ডা আমাদের পায়ে পায়ে ঘোরে, আমরাও তাকে কোলে তুলে নিই দিব্যি। শীতের ট্রেলার দেখেই জমিয়ে বসি।
আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতেরই তো কদর হওয়ার কথা। মে-জুন-জুলাইয়ের গনগনে কড়াইয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে আমরা চোখ বুজে স্বপ্ন দেখি ডিসেম্বরের ডিপফ্রিজের ... ট্রাঙ্কে শুইয়ে রাখা নিরপরাধ একজোড়া গ্লাভস্... আসছে শীতে তার হাতমস্কো করতে পারবে তো? একটা দুটো পিকনিক, সরুচাকলি থেকে গোরুমারা, শোবার ঘর থেকে ডোভার লেন... সবই তো শীতের ব্র্যাকেটের মধ্যে। তাই জুন মাস থেকেই মনে মনে ক্রিসমাস আমাদের। শীতকাল কবে আসবে...
এই যে সারা বছর ধরে মনে মনে একটা চোরা শীত নিয়ে ঘোরাফেরা, তার আরও একটা কারণ আছে। প্রেম। ন’মাস ধরে রোদে পোড়া জলে ভেজা মন আর শরীর বেঁচে ওঠে এই ফুরফুরে রোদের তিন মাসে। ভালবাসার মানুষটাকে আরও একটু কি বেশি ভাল লাগে, আহ্লাদের শীতকালে? হতেও পারে!
এই তিন মাস তো আমরা বেঁচে নিই এক বছরের ভাললাগার জীবন। অকথ্য ঘাম নেই, জঘন্য হাঁটুজল নেই, বাড়ি ফিরে ধপাস নেই... বরং উৎসাহী মাফলারে গলা জড়িয়ে যেখানে খুশি হাজির।
অফিস-কলেজ-বাস-মেট্রো-ঝগড়া-অভিমান অতটা গায়ে লাগে না। ঠান্ডা হাওয়ায় ঝাপটারা আছে কী করতে? মাথার ভেতর একটা মুখচোরা স্মাইলি নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের শীতযাপন শুরু হয়ে যায়।
শরীরের শীতকাল মানে তাই মনের বসন্তকাল। শীতের সঙ্গে বিষণ্ণতা, পাতাঝরা, সমাপ্তির যে-ইমেজ চিরকাল জড়িয়ে আছে, তাকে দূরে সরিয়ে রেখে মনে মনে ভালবাসার বসন্ত উৎসব। আর বাঙালির হয়ে কবিতা সেই উৎসবের সাক্ষী থেকেছে চিরকাল। দিন পাল্টেছে, ভালবাসার ভাষা পাল্টেছে, বাংলা কবিতাও পাল্টেছে। কখনও আর্তি, কখনও দাবি, কখনও আড়াল, কখনও খোলামেলা... বারবার পাল্টে যেতে যেতেও সে শীত-বসন্ত-ভালবাসার হাত ছাড়েনি কখনও। মনের আদর থেকে শরীরের ঝোড়ো ভালবাসায় সে তার সই রেখে গেছে বরাবর।
নাহ্, জীবনানন্দের হেমন্ত বা শীতে আজ ঢুকছি না। সে একটা চক্রব্যূহের মতো ব্যাপার, পাঠক কেবল ঢোকার রাস্তাই জানে। কিন্তু লেখালেখির গোড়ার দিকে তাঁরই ধর্মানুসারী বিনয় মজুমদার সমস্ত ভাবালুতাকে সপাটে সরিয়ে রেখে বলছেন, ‘সকল ফুলের কাছে মোহময় মন নিয়ে যাবার পরেও/ মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে’। ভালবাসা কি ফুল আর মাংসের মাঝখানে আটকে থাকে কোথাও? এ বড় জটিল প্রশ্ন।
কিন্তু শীতকাল বলে, কাছে ঘেঁষে বসো। দ্যাখো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে, এখন একটু জড়ামড়ি করে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। বরং উত্তাপ বিনিময়ের একটা ছোট্ট রাস্তা তৈরি হবে দুই মন, দুই শরীরের মাঝখানে, ‘দুটো হাত কথা বলছে: কী শীত। কী শীত। ভাল আছ?/ দশ আঙুল কথা বলছে: পাজি সর। সরে যা। যেয়ো না।/ নখ বলছে: ছিঁড়ে নেব। আঙুল ঘুরেই বলল: আমার সোনাটা।’ ... ঠিক এই রকমই তো হয়, যেমনটা লিখেছেন পিনাকী ঠাকুর তাঁর কবিতায়। এই ছুঁতে চাওয়া, এই ছোঁয়া সরিয়ে দিয়ে কাছে টেনে নেবার অছিলা, এই আলগা রোম্যান্সের শীতই তো মনের বসন্তকাল।
মনে পড়ে, আমাদের কৈশোরে কারও হাত ছোঁবার জন্যও অন্ততপক্ষে মাসখানেকের একটা প্ল্যান থাকত। যে ভাবে জঙ্গিরা এগোয়, সে ভাবেই। ভালবাসার মধ্যেও তো এক ধরনের জঙ্গিপনা আছে। সে কখন কোত্থেকে ফেরে, কোন বাসে সাধারণত কোন সিটে বসে, কোন স্টপেজে উঠলে তার পাশের সিট খালি পাবার একটা হাল্কা সম্ভাবনা থাকতে পারে, গেছোদাদা-মার্কা এই সব হিসেব কষা হত। শীতকালেই এ সব সুযোগ আসে, ঘাম হয় না।
শেষমেশ ঐতিহাসিক কোনও এক দিন যদি এমন সিট পাওয়াও গেল, তবু সাহস জুটল না। ওই সেরা একজোড়া নরম হাতের দিকে তাকিয়েই পেরিয়ে গেল শীতের সব ক’টা স্টপেজ। যেমন অংশুমান কর লিখছেন, ‘লম্বা থুতনি মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সন্ধে হল/ দূরে, অন্য একটা জীবনের ভেতর ভদকা খুলল কেউ/ যে জীবন আমাদের নয় তার ভেতর শুয়ে থাকবার ভান করল/ আমরা দেখলাম সন্ধে নামল/ বরফের মতো সন্ধে ঝুপঝাপ নেমে আসতে লাগল/ সাদা হয়ে গেল মেয়েদের থুতনি, চেয়ে থাকা/ যে জীবন আমাদের নয় তার দিকেই তো যেতে চাই।
অন্য একটা জীবন। আসলে আমাদের সবার জীবন যে কত কত অন্য জীবনে মিশে আছে... তার হিসেব হয় না। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক, ভয়ের দশক থেকে ক্ষয়ের দশক, কত রকম বদলই তো দেখেছি আমরা। কত রকম জীবন বেঁচে নিয়েছি এক জীবনে। কত রকম প্রেমের রঙে আঁকা হয়েছে আমাদের প্রচ্ছদ। তাতে কি শরীর আসেনি? শীতের কুড়মুড়ে আগুনের আলোয় আমরা কি সেঁকে নিতে চাইনি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, অথচ গনগনে ইচ্ছেগুলো?
স্বীকার করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দ্বিধা থেকে দাবির রাস্তাটা পার হয়ে এসে বললেন, অরুন্ধতী, সর্বস্ব আমার/ হাঁ করো, আ-আলজিভ চুমু খাও, শব্দ হোক ব্রহ্মাণ্ড পাতালে/ অরুন্ধতী আলো হও, আলো করো, আলো, আলো, / অরুন্ধতী আলো—/ চোখের টর্চ লাইট নয়, বুকে আলো, অরুন্ধতী, লাইট হাউস হয়ে/ দাঁড়াবে না?’ এই কয়েকটা লাইন বোধহয় আমাদের সকলের প্রেমের ইস্তেহার হয়ে দাঁড়িয়েছিল একদিন। অথবা শঙ্খবাবুর সেই প্রবাদকাব্য, ‘যুবতী কিছু জানে না, শুধু/ প্রেমের কথা ব’লে/ দেহ আমার সাজিয়েছিল/ প্রাচীন বল্কলে।/ আমিও পরিবর্তে তার/ রেখেছি সব কথা:/ শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি/ আগুন, প্রবণতা’। সে-আগুন আমাদের কিছু কম পোড়ায়নি।
স্বীকার করলেন আরও একজন, সুমন চট্টোপাধ্যায়, অধুনা কবীর সুমন। তাঁর ভাষায় শরীর আর মনের স্বাধীনতা সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের অন্য এক বসন্তকাল। আজ যখন ভালবাসার ভাষাই কমবয়েসি ছেলেমেয়েদের প্রতিবাদের হাতিয়ার, তখন মনে পড়ে যায়, ‘ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো প্রেমের পদ্যটাই/বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই’।
সময় তো এ ভাবেই সাক্ষী রাখে ভাষাকে, গান আর কবিতা তো এ ভাবেই হয়ে ওঠে আমাদের ভালবাসার সত্যিকারের ইতিহাস। কোথাও এসে প্রেম আর বিপ্লব যেন এক হয়ে যায়, ‘ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে’ আমরা নতুন করে বেঁচে উঠি।
আরেকভাবে স্বীকার করলেন সুবোধ সরকারও। প্রেম মানে কি কেবল শরীরের যৌবন? তা তো নয়। অনেক দুপুর রোদ পেরিয়ে আসার পর সন্ধের দিকে চুপচাপ বসে সময়ের আঁচ পোহানোও তো প্রেমই। মজার মোড়কে তিনি লিখলেন একখানা সত্যি কথা, ‘প্রেমিকারা চালু মাল, সে-মালও পাল্টায়/ বউ কিন্তু সুখে দুঃখে বউ থেকে যায়’। ভাষার ব্যবহারে এ-পদ্যে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে, অনেকে সাময়িক কৌতুকও বোধ করতে পারেন। কিন্তু বিয়ের পর দশখানা শীত-বসন্ত পার করে আমারও এ-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে! প্রেমের বিয়ে থেকে বিয়ের প্রেমে পৌঁছনোর রাস্তায় কতশত পরীক্ষার তুষারপাত, ভালবাসলে বউই বোধহয় পারে সেগুলো পেরিয়ে আসতে। বরেরা পারে না ততটা।
তবে হ্যাঁ, সবরকম প্রবণতাই হয়তো পাল্টায় সময় থেকে সময়ে, আর সেটাই স্বাভাবিক।
তিন দশক আগে একজনের হাত ধরতে দ্বিধা হত, আর ধরলেও আমরা রণজিৎ দাশের মতো ভাবতাম, ‘অন্ধ ঘড়ি নির্মাতার ভাই আমি, তুমি কি তা জানো?/ তোমার শরীর, আমি জানি, এক গভীর পিয়ানো’। আজ কিন্তু একজনের হাত ধরেও তিন জনের সঙ্গে কথা বলা যায়। সংযোগের জাল হৃদয় পেতে আমাদের ধরেছে। প্রতি মুহূর্তে সংযুক্ত থাকার, নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার অবুঝ হাওয়ায় আমাদের আরও কয়েকটা শীতকাল কেটে যাবে হয়তো।
কমলালেবুর খোসার গন্ধে ভরে ওঠা দুপুরগুলো, ছাদের এককোণে খুলে রাখা জিভে-জল-আনা আচারের বয়ামগুলো, ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধের মাঠে হারিয়ে যাওয়া ক্যাম্বিস বলগুলো যে-প্রেমের সাক্ষী, সেই প্রেম এখন একটু কি পিছিয়ে পড়ছে? মনের বসন্ত কি অন্য কথা বলছে আজ? ‘বসন্তের কথা থাক/ বরং আলু পটলের কথা হোক... দেখ, দিবা-দ্বিপ্রহরে, /কেমন লিফলেট চিবুচ্ছে/ছাগলের পাল—/এমন চমৎকার মিঠে দিনে/ বসন্তের কথা থাক/বরং অনলাইনে থাকা যাক/ বরং মেসেজে মেসেজ ভেসে যাক’। সেমন্তী ঘোষের কবিতার এই লাইন ক’টাই উত্তর হিসেবে যথেষ্ট।
কিন্তু শত দোষ কাঁধে নিয়েও প্রেম আছে, থাকবেই। শীতকালের বিষণ্ণতাকে স্বীকার করে নিয়েও সে বলবে, ‘দেখা হলেই রোপণ করে গাছ/ শিকড়ে তার বাঁধছে বাসা শীত/উপড়ে ফেলি সব ঠিকানা তার/ দেখা হলেই বিষণ্ণ সঙ্গীত’।
তরুণ কবি সুমন ঘোষের এই চার লাইনকে সঙ্গী করেই বলি, আমাদের ভালবাসার শিকড়েও কিন্তু বাসা বেঁধে আছে সেই শীত, যার ঠিকানা জানতে বারবার ডেকে আনি সুপর্ণাকে। যে-তিন মাস আমাদের ভালবাসার, সেই তিন মাস ঘুমিয়ে থাকার অঙ্গীকার করে আর যেমন ফিরলেনই না ভাস্কর চক্রবর্তী। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেলেন বি.টি. রোডের ধার আর বয়স থমকে থাকা সুপর্ণাকে। কেবল ভালবাসব বলেই আমরা রোজ যাকে জিজ্ঞেস করি, ‘শীতকাল কবে আসবে?’ আসলে তো শীত নয়, শীতের মোড়কে এক বসন্তের অপেক্ষাতেই কেটে যায় আমাদের গোটা জীবন।
জাতিস্মরের শীতকাহিনি
শ্রীজাতর এই কবিতাটি ‘পত্রিকা’র জন্য লেখা
উলের গায়ে ভুলের কাঁটা
নকশা তোলো ফুলের মতো
শীতদুপুরে ছড়িয়ে আছি
ধোঁয়ার মতোই ইতস্তত।
এ সব পাড়ায় রাত নামে না
রোদ্দুরে দিন খুব জেহাদি
মনে পড়ার দায় কী তোমার?
স্মৃতি ভীষণ মিথ্যেবাদী।
যে খুব আদর করতে পারে
অবজ্ঞা তো তাকেই মানায়
দস্তানারা গল্প শোনে
সস্তা কোনও সরাইখানায়...
কেমন ছিল শীতের বেলা
তুষারপাতে ঠোঁটের নরম...
এ সব নেহাত আগের জীবন
প্রেমিক কিন্তু জাতিস্মরও
ফেরাও তাকে উলের কাঁটায়
ঘেরাও করো নকশা দিয়ে
কেমন ধাঁধা, শীতের বাতাস
চলল বয়ে চোখ ধাঁধিয়ে...
চোখের নীচে অল্প কালি
বরফ জমে সড়কপিছু...
যখন কেবল খুঁজে বেড়ায়
চুমুর চেয়েও নোনতা কিছু...
দস্তানাকেই রাখছি হাতে
ফেলতে থাকো সব পুরনো
নতুন করেই চাইব তোমায়
যদি আমার গল্প শোনো...
ভুলে যাওয়ার খুব ভেতরেই
মনে পড়ার ছকটা চেনা।
বসন্তে ঠিক আসব ফিরে
এক মাঘে তো শীত যাবে না!