মুখোমুখি ২...

বাবার ‘গোপাল’ ডাকে আমি সাড়া দিইনি

ব্যস, সজোরে এক চড়। এমনই মানুষ ছিলেন ওড়িশি নৃত্যের পথিকৃত্‌ কেলুচরণ মহাপাত্র। তাঁরই পুত্র রতিকান্ত মহাপাত্রের সঙ্গে আড্ডা দিলেন স্বাতী বসু।ব্যস, সজোরে এক চড়। এমনই মানুষ ছিলেন ওড়িশি নৃত্যের পথিকৃত্‌ কেলুচরণ মহাপাত্র। তাঁরই পুত্র রতিকান্ত মহাপাত্রের সঙ্গে আড্ডা দিলেন স্বাতী বসু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:১৬
Share:

প্রশ্ন: পাঁচশোরও বেশি দেশ-বিদেশের ওড়িশি শিল্পীকে দিয়ে নৃত্য উপস্থাপনা। কোরিওগ্রাফার হিসেবে গিনেজ বুকে স্বীকৃতি। পরিচালক ছিলেন আপনি?
আন্তর্জাতিক ওড়িশি নৃত্য উত্‌সব উপলক্ষে ২০১২ সালে আইপ্যাক (আমেরিকা) ও ওড়িশা সরকারের যৌথ উদ্যোগে তিন গুরুর (পঙ্কজচরণ দাস, দেবপ্রসাদ দাস ও কেলুচরণ মহাপাত্র) কম্পোজিশন উপস্থাপিত হয়েছিল একসঙ্গে। কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে ওই অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম আমি এবং গিনেজে নাম ওঠা।

প্র: কত্থক এবং বিরজু মহারাজ, ওড়িশি নৃত্য ও কেলুচরণ মহাপাত্র এক এবং অবিচ্ছেদ্য। সংযুক্তা পাণিগ্রাহী, কুমকুম মহান্তি, সোনাল মানসিং, মাধবী মুদগল, গিরিধারী নায়েক প্রমুখের মতো শিল্পীরা তৈরি হয়েছেন কেলুচরণজির গুরুকুলে। ওঁর সন্তান হিসেবে নয়, বরং নৃত্যশিল্পী তথা পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবে আপনি কী মনে করেন?
কেলুচরণ মহাপাত্র ছিলেন ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’। একাধারে নৃত্যশিল্পী, গায়ক, সঙ্গীতকার, অভিনেতা ও তবলা বাদক এবং চিত্রকর। জীবনে নানা ধরনের কাজ ও ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়েই ওড়িশি নৃত্যশৈলীকে সমৃদ্ধ করেছেন।


প্র: নানা ধরনের কাজ মানে?
পটচিত্রকরের কাজ, নদী থেকে ৬০ ঘড়া করে রোজ জল বইবার কাজ। এক দিন ৬০ ঘড়ার বদলে প্রায় শ’খানেক ঘড়া জল বয়ে এনে হাজির হয়েছিলেন পানের আড়তে। মালিক অবাক। বাবা জানান, গান করতে করতে ওঁর গুনতে খেয়াল ছিল না। সেই মালিকই বাবাকে বলেছিলেন, ‘বেটা, এই কাজ তোমার জন্য নয়।’

প্র: কেলুচরণজির বাবা একেবারেই চাননি ছেলে নৃত্যশিল্পী হোক?
দাদু পরিষ্কার বলেছিলেন ছেলে হয়ে কোমর হিলানার কাজ কদাপি নয়! ঠাকুমা লুকিয়ে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন মোহনসুন্দর দেব-গোস্বামীর কাছে। উনিই বাবার প্রধান গুরু। ওঁর কাছে বারো বছর তালিমের পর বাবা নাচ, গান, অভিনয় থেকে মঞ্চকুশলতা দারুণ ভাবে আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। সেখান থেকে অন্নপূর্ণা থিয়েটার। আমার মা লক্ষ্মীপ্রিয়া মহাপাত্র তখন অভিনেত্রী। ওঁদের দুজনের একসঙ্গে প্রথম পরিবেশনা ছিল ‘দশাবতার’ ১৯৪৭ সালে।

প্র: ওড়িশি নৃত্যশৈলীতে শরীর সঞ্চালনা, ভঙ্গিমার পরিবর্তন এনেছিলেন কেলুচরণজি। তাতে ড. দেবী শেঠীরও নাকি ভূমিকা ছিল?
১৯৯০ সাল বাবার জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট, চৌঠা এপ্রিল, ১৯৯০-এ বাবার বাইপাস সার্জারি করেন ডা. দেবী শেঠী। তার আগের দিন বাবা ডাক্তারবাবুর কাছে অপারেশনের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য জানতে চান। উনিও গোটা প্রক্রিয়াটা সহজ করে ব্যাখ্যা করেন। বাবা শরীরবিজ্ঞান নিয়ে বিশেষ উত্‌সাহিত হয়ে পড়েন। এর পরও ডাক্তারবাবুর সঙ্গে এই চর্চা জারি ছিল। তার পরই বাবা ওড়িশি নাচে ‘চৌক’ ভঙ্গিমাকে ‘অধর্র্চৌক’ করলেন। অহেতুক জারিং মুভমেন্ট বর্জন করলেন। শিল্পীর চেস্ট মাসলের উপর অকারণ চাপ ও রক্তসঞ্চালন নিয়ন্ত্রিত করতে বাবা ওড়িশি নৃত্যকলাকে আদ্যন্ত পরিশীলিত করলেন। উদ্দেশ্য, নৃত্যরত শিল্পীর নিজের শরীরের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। নাচের পোশাকেও শিল্পীর কমফর্টের কথা ভেবে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

প্র: নৃত্যশিল্পী হিসেবে আপনার মঞ্চে অভিষেক হয়েছিল কত বছর বয়সে?
পরিবেশেই নাচ থাকলে যা হয় আর কী! কিশোর বয়সেই স্টেজে হাতেখড়ি। তবে বাবার কর্মযজ্ঞের সঙ্গেই থেকেছি দশ বছর বয়স থেকেই। নৃত্যশিল্পী, স্রষ্টা, প্রশিক্ষক হিসেবে কেলুচরণ মহাপাত্রকে সমৃদ্ধ হতে দেখেছি। একেকটা ল্যান্ডমার্ক ‘পল্লবী’ ও ‘অভিনয়’ আইটেম সৃষ্টি হয়েছে আমার সামনে। সংযুক্তা পাণিগ্রাহী, কুমকুম মহান্তিকে বাবা সেগুলো তোলাতেন।

প্র: আপনার বাবা একবার আপনারই নাম ভুলে গিয়েছিলেন...
কোনারক ফেস্টিভালের জন্য ডান্স ব্যালে ‘চন্দ্রভাগা’-র রিহার্সাল চলছিল। সংযুক্তা পাণিগ্রাহী ‘সূর্য’, আমি ‘মদন’-এর ভূমিকায়। হঠাত্‌ বাবা ‘গোপাল, গোপাল’ বলে কাউকে একটা ডাকতে শুরু করলেন। আমার ডাকনাম ‘শিবু’। তাই সাড়া দিইনি। হঠাত্‌ বাবা পেছন থেকে এসে আমায় সজোরে একটা থাপ্পড় বসালেন। সেই সময় কে তাঁকে বোঝাবে যে যার নাম শিবু সে গোপাল ডাকে সাড়া দেবে কেন?

Advertisement

প্র: কেলুচরণ মহাপাত্রের মতো মহারথী পিতা থাকার সুবিধে এবং অসুবিধে কী কী?
ভাল মন্দ দু’দিকই আছে।


প্র: ইন্দো-চিন ছবি ‘দ্য ডিজায়ার’-এ শিল্পা শেঠীকে তিনি নাচ শিখিয়েছেন। তাই না?
অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্রী। সাত দিনের টানা ওয়ার্কশপ যথেষ্ট মন দিয়ে করেছিলেন তিনি। জয়া প্রদাও ছিলেন ওঁর সঙ্গে।

প্র: একজন নৃত্যশিল্পীর ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’ হওয়াটা কতটা জরুরি?
একজন নৃত্যশিল্পীর শুধু নাচ নয়, গান, পাখোয়াজ বা মার্দালা বাদন থেকে মঞ্চ, আলোর প্রক্ষেপণ সবই জানা ও বোঝা জরুরি।

প্র: আজকের প্রজন্ম যারা নাচ নিয়ে এগোতে চায় এত কিছু শিখতে হবে শুনে ভয় না পেয়ে যায়!
‘লগন’ আর ‘ইচ্ছা’ থাকলে সময় বার করে নেওয়াই যায়। অভিজ্ঞতা, বয়স, নিয়মিত অভ্যাসেও বোধ তৈরি হয়, যা থেকে অনেক কলাকৌশল এমনিই রপ্ত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের ভুমিকাও গৌণ নয়।

প্র: যে নাচকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে উদ্যোগী, তার মূলস্রোতের পড়াশুনোর কী প্রয়োজন?
নাচ মানে তো অঙ্ক, জ্যামিতি, সাহিত্য, মাইথোলজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলও বটে। এ সবে বেসিক শিক্ষা ছাড়া ইনোভেশন, ক্রিয়েশন কিছুই বেশি দূর এগোবে না। ‘অভিনয়’ আইটেম করতে গেলে সাহিত্য না জানলে চলবে কী করে?

প্র: ক্লাসিক্যাল গান-নাচ-বাদ্যযন্ত্রের গুরুরা কঠোর প্রশিক্ষক ছিলেন। ভুল করলে সজোরে লাঠির বাড়িও জুটেছে। জেনারেশন এক্সকে কেমন বুঝছেন? ওদের কতটা কঠোর অনুশাসনে বাঁধা সম্ভব হচ্ছে?
কঠোর না হলে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছানো যাবে না। এমন ছেলেমেয়েরা আছে, যারা ৩৬৫ দিনই নাচ অভ্যেস করে। নিয়মিত তালিম নেয়। শৃঙ্খলাপরায়ণ। তবু এটা বাস্তব যে, প্রতি একশো ছাত্রছাত্রী পিছু একজনই সাফল্যের দিকে এগোতে সক্ষম হয়। আসলে ছাত্রছাত্রী অনেক পাই, শিষ্য পাওয়াই তো বড় দুষ্কর।

প্র: ছাত্রছাত্রী আর শিষ্য এক নয়?
তফাত এটাই ছাত্রছাত্রী আসে যায়। শিষ্য থেকে যায়। যেমন কেউ পুকুরের ওপর স্তরেই সাঁতার কাটতে স্বচ্ছন্দ। গভীরে সে ঢুকতেই চায় না। সেই মন ও মনন নেই। কেউ পুকুরের তলদেশে ঝিনুক খুঁজে মুক্তোর সন্ধানে ব্রতী হয়। যাই করুন, যাই শিখুন খিদে থাকাটা জরুরি। সেটাই তাড়িয়ে নিয়ে যায় যে।

প্র: কেলুচরণজি নেই আজ দশ বছর। আপনার হাত ধরে কেলুচরণজি ঘরানায় নতুন কোনও সংযোজন...
নাচের ঐতিহ্যকে অটুট রেখে নতুন কিছু করাটাই আমার চ্যালেঞ্জিং। নিও ক্লাসিক্যাল ফর্ম সে রকমই একটা এক্সপেরিমেন্ট। এ ছাড়া তিরিশটারও বেশি আইটেম করার চেষ্টা করেছি।

Advertisement

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement