ছবি: তন্ময় দাস
দিনটা ১২ জানুয়ারি। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। কলকাতা শহরে তাঁর জন্মদিনের নানা অনুষ্ঠানের মধ্যেও অন্য এক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অনুষ্ঠিত ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের দীক্ষামঞ্জরীর ওড়িশি নৃত্যের অনুষ্ঠান। এটি এমন এক অভিজাতের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ—যাঁর নাম অমিতাভ বচ্চন। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে কথা দিয়েছিলেন এক বার ডোনার প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতে আসবেন। তিনি এলেন, শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার নিদর্শন দেখলেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির যে ধারাকে ডোনা বহন করে চলেছেন তার প্রভূত প্রশংসা করলেন। দুটি শিশু তাঁকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর পরে সংস্থার সভাপতি স্বপ্না রায় তাঁকে শাল পরিয়ে সম্মান জানালেন। সহ-সভাপতি সৌরভ ও সংস্থার কর্ণধার ডোনা উভয়েই তাঁকে কিছু স্মারক ও উপহার প্রদান করলেন। অমিতাভ জানালেন এই সম্মান পেয়ে তিনি অভিভূত এবং এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেও গর্বিত। সৌরভও তাঁর ছোট্ট প্রত্যুত্তরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ডোনার নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের উপদেশ ছিল ‘সৃষ্টি করবে-ভাঙবে, গড়বে কিন্তু দেখো তা যেন ধ্রুপদী ওড়িশির বিশুদ্ধতাকে কখনও অতিক্রম করে নষ্ট না করে। এই নাচের সম্ভার রইল তোমাদের জন্য।’ ডোনা দেখালেন সংস্কৃতির বিস্তীর্ণ ধারার মধ্যে যে ধারাটিকে তিনি বহন করে চলেছেন তার দুরূহতম প্রকরণটিকে আয়ত্তে রেখেও কী করে শাস্ত্রীয় নৃত্যকে অভিনব ভাবে উপস্থাপন করা যায়। সুশিক্ষা এবং অভিজ্ঞতায় সারা পৃথিবীব্যাপী নৃত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি রসলোকের দ্বারে উপনীত হতে পেরেছেন বলেই এই উপস্থাপনাটির পরিকল্পক হতে পারলেন।
অনুষ্ঠানের সূচনা ওড়িশি চিরাচরিত মঙ্গলাচরণ দিয়ে এবং তার পরে প্রদর্শিত হল বটু, পল্লবী প্রভৃতি। নবদুর্গা অনুষ্ঠানের আগেই এসে পৌঁছলেন অমিতাভ এবং তাঁর উপস্থিতির মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখলেন রায়া ভট্টাচার্য, তাঁর বাচনকৌশলের মাধ্যমে। চমৎকার প্রাঞ্জল ভাবে কণ্ঠকে সংযত রেখে অমিতাভ সম্বন্ধে তিনি যা বললেন তা খুব ভাল লাগে। এইখানেই একজন পরিণত শিল্পীর সার্থকতা যা অযথা আবেগে ভেসে যায় না। ডোনা ভিক্টোরিয়ায় সিঁড়ি থেকে দালান সবটুকু ব্যবহার করেছিলেন নৃত্যপদগুলি প্রদর্শনের জন্য, যাতে অংশ নিয়েছিল আশি জন ছাত্রী। আর সাড়ে তিনশো ছাত্রী একসঙ্গে সুশৃঙ্খল ভাবে অমিতাভকে শ্রদ্ধা জানাল তাঁরই কণ্ঠে গীত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ গানটির মাধ্যমে। সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। সবাই উজ্জ্বল লাল রঙের পোশাকে মুদ্রার মাধ্যমে অঙ্গ সঞ্চালন করছেন—আর অমিতাভ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একেবারে সুশৃঙ্খল উপস্থাপনা। এর থেকে ভাল শ্রদ্ধার্ঘ্য আর অমিতাভের জন্য কী হতে পারে। সন্ধ্যার শেষ নিবেদন ছিল অর্ধনারীশ্বর নৃত্যপদটি।
এই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগেই কলকাতার আরও একটি দ্রষ্টব্য স্থান ভারতীয় জাদুঘর নূপুরের ঝংকারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল ‘উৎসবে বিজয়া’ শীর্ষক এক ওড়িশি নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। পরিকল্পনা ও পরিচালনা ছিল ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়েরই। জাদুঘরের প্রাঙ্গণের প্রতিটি অলিন্দে মন্দির ভাস্কর্যের আদলে বিভিন্ন ভাস্কর্যসুলভ স্থির ভঙ্গিমায় সজ্জিত নৃত্যশিল্পী রেখে যে একটা আলাদা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি সার্থক। এ দিনের অনুষ্ঠানে তিনি ও তাঁর দীক্ষামঞ্জরীর সহশিল্পীরা সাবলীলতার মাধ্যমে এক বিরল নৃত্য প্রদর্শন করলেন।
স্বল্প পরিসরে যে নৃত্যপদগুলি নির্বাচিত হয়েছিল তার মধ্যে ছিল অর্ধনারীশ্বর, শিবস্তোত্রম, বটু, আরবিপল্লবী, জটায়ু, মোক্ষ, দুর্গাস্তুতি ও মোক্ষ। প্রথমেই জটায়ু-মোক্ষর কথা উল্লেখ করতে হয়। ডোনা ও সহশিল্পী রঘুনাথ দাসের নৃত্যাভিনয়ে রামায়ণের জটায়ু বধের ঘটনা প্রদর্শিত হল। এক কথায় অসাধারণ। শোক, বিষাদ, আনন্দ অনায়াসে প্রতিফলিত হয় উভয়ের গতিময় যুগ্মনৃত্যে। এই নৃত্যপদটিতে ডোনার মুখাবয়বের ভঙ্গি অথবা অভিনয়ের পরিমিতি বোধ প্রশংসনীয়। বিশুদ্ধ নৃত্যপদ আরবি পল্লবী ও ছন্দ, গতি এবং লাবণ্যের একত্রীকরণে উৎসারিত আনন্দধারায় প্লাবিত হয়। খুব সংক্ষিপ্ত হলেও সমগ্র অনুষ্ঠানে নৈপুণ্য আর সৌষ্ঠবই প্রাধান্য পেয়েছিল।