ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
এত সুর আর এত গান-এর শিল্পী সুবীর সেন বেশ ক’বছর ধরে আর গাইতে পারছিলেন না।
তা বলে গানের মধ্যে ওই যে অনুযোগ, যদি গান থেমে যায়, ‘সেই দিন তুমিও তো ওগো জানি ভুলে যাবে যে আমায়’— তা একেবারেই সত্যি হয়নি।
হেমন্ত, মান্না, অখিলবন্ধুর মতো ওঁর গান বাঙালির ঠোঁটে ভর করেছে। বাঙালির বেলা বয়, প্রেম হয়, মন কথা কয় সুবীরের গানে। উনি কবে থেকে গাইছেন না, তা কারও মনে থাকেনি।
যখন গলা দিচ্ছে না, তখন কী ভাবে চলে সময়?— এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে বছর দুয়েক আগে। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘‘নিজের কিছু গান বাজিয়ে শুনি।’’
মানে নিজেই নিজের শ্রোতা হয়ে গেছেন?
বললেন, ‘‘কী করব, ওটাই নিজেকে ফিরে দেখা আমার এখন!’’
স্তোক দিতে নয়, কোটি বাঙালির হয়ে বলতে হয়েছিল, ‘‘আমরাও তো নিজেদের দেখি, আপনার গানে গানে।’’
আর হায়, হায়, কী গান সে-সব!— ‘সারাদিন তোমায় ভেবে হল না আমার কোনও কাজ’, ‘হয়তো তোমার অনেক ক্ষতি করেছি, কাছে এসে ভালবেসে’, ‘নয় থাকলে আরও কিছু ক্ষণ’, ‘পাগল হাওয়া’, ‘এ যেন সেই চোখ’, ‘তুমি বলেছিলে’ বা ‘মোনালিসা, তুমি কে বলো না’।
ষাটের দশকের যুবক-যুবতীদের মনে হত সুবীর ওদের পার্সোনাল ডায়েরির কথা তুলে তুলে গেয়ে দিচ্ছেন। কিংবা ঘুরিয়ে দেখলে, সুবীরের এই সব গানই অবলীলায় ঢুকে পড়েছে তাদের রোজনামচায়। আর কী ভাবে!
না, এক অতুলনীয় রোম্যান্টিক, সুরেলা প্রায় নিখুঁত, ব্যারিটোন স্বরে। যে গলায় সুর লাগালেই একটা গান দাঁড়িয়ে যায়। যে-গলা ক্ল্যাসিকালের রেওয়াজ করেই বানানো হয়েছে (লখনউয়ের ম্যারিস কলেজের গানের গ্র্যাজুয়েট সুবীর, নিজের বছরে ফার্স্ট, পরীক্ষা নিয়েছিলেন রতনজনকার!)। আর সেই কণ্ঠে কী এক ভদ্র, শিক্ষিত বাঙালি উচ্চারণে বাণী বলা। এবং, সর্বোপরি, বাংলা গানেও কোথাও যেন একটা স্মার্ট সাহেবি মেজাজ। যেটা শিল্পী রপ্ত করেছিলেন ন্যাট কিং কোলের গান শুনে শুনে, ওই স্টাইলের অনুসরণে।
প্রায় ষাট বছরের গানের জীবনে সুবীরের বাংলা গানের সংখ্যা কিন্তু দেড়শ’ ছাড়ায়নি। কারণ কথা ও সুর পছন্দ না হলে উনি গান তুলতেন না। তাই ভুলে যাবার মতো একটি গানও তিনি রেকর্ড করেননি। শেষ দিন পর্যন্ত নিজের সব গানই গেয়েছেন বই না দেখে। এবং যখনই গান ধরেছেন মনে হয়েছে, যেন রেকর্ড বেজে উঠল।
সুর কী ভাবে লাগাতে হয়, গলা কী করে ছাড়তে হয়, এ ব্যাপারে দৈবশক্তি ছিল সুবীরের। ওঁর ২০ নম্বর পণ্ডিতিয়া প্লেসের বাড়িতে এক দিন গজল শোনাচ্ছিলেন হারমোনিয়াম ধরে। উনি এক দেওয়ালের গায়ে, আমি উল্টো দিকের দেওয়ালের গায়ে। অতি নম্র করে উনি কথা ছাড়ছেন, যা দশ ফুটে দূরে আমার কাছে বড় আর গোল হয়ে পৌঁছচ্ছে, বার বার। ক্রমান্বয়ে।
ধ্বনির এই ডায়নামিক্সকে সুবীরদা বলতেন ফোনেটিক ব্যালান্স। যেটা নাকি ওঁর মধ্যে প্রথম শনাক্ত করেন অনুপম ঘটক। ‘‘এটা আর ছিল হেমন্তদার,’’ বললেন সুবীর। যে-হেমন্তর গান গেয়ে পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে জলসা মাত করতেন তিনি। বললেন, ‘‘এক দিন হল কী, দিব্যি জলসা মাতাচ্ছি, হঠাৎ শুনি হেমন্তদা এসে পড়েছেন। শুনে নাকি বলেছিলেন, দিব্যি তো গাইছে, গাক না! আমি বসছি।’’
সুবীরের গান গেয়ে জলসা জমানো ও পসার করার শিল্পীর অভাব হয়নি। কিন্তু গুণমানে এতটাই ফারাক থেকে গেছে মূল ও কপিতে যে শ্রোতা ক্রমাগত ফিরে গেছে সুবীরের প্রথম আদিতে, বুঝেছে সুবীর সেনের বিকল্প নেই,
বলতে নেই, সুবীর সেনই হয়তো সুবীর সেনের বিকল্প। বাইশ বছর বয়েসে সুধীন দাশগুপ্তর কথা-সুরে ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’ গেয়ে জীবনের প্রথম রেকর্ডেই হিট দিলেন।
এর দু’বছর পরেই ১৯৫৮-য় বম্বে গিয়ে শঙ্কর-জয়কিষেণের সুরে ‘কাঠপুতলি’ ছবিতে গাইলেন ‘মঞ্জিল ওহি হ্যায় পিয়ার কে’ এবং সে-গানও বিনাকা গীতমালার রেটিং-এ এক নম্বর।
হিন্দি ছবিতে প্রথম গানে হিট তার আগে কারও ছিল না। সেজন্য সুবীরকে সর্বাগ্রে অভিনন্দন জানাতে ওঁর ফ্ল্যাটে এসেছিলেন তালাত মাহমুদ। তত দিন অবধি যাঁর রেকর্ড ছিল জীবনের দ্বিতীয় ছবির গানে হিট। যেটা সুবীর ভেঙেছিলেন।
এই তালাত মাহমুদ ক্রমে এক আদর্শ হন সুবীরের। ওঁর প্রবল পছন্দের শিল্পী ও মানুষ হন গীতা দত্ত। আর খুব প্রেমে পড়েন সলিল চৌধুরীর সুরারোপের।
আজ চলে গেছেন বলে নয়, সেই ছয়ের দশক থেকেই বাঙালি মরমে বুঝেছে সুবীর সেনের সঙ্গে এক দীর্ঘ জীবন তার পড়ে আছে আগামীতে। জীবৎকালে অনেক অবজ্ঞা পেয়েছেন সুবীরদা, প্রচুর ঈর্ষা কুড়িয়েছেন, আবার অগণিত অনুকরণকারীর মতো এত-এত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভক্ত পেয়েছেন যে জীবনের শেষ দিকে একটা মরণোত্তর খ্যাতিরও স্বাদ পেতেন ওঁর গানের প্রতিক্রিয়ায়।
ওঁর জীবনকৃতি সম্মানের এক অনুষ্ঠানে শুধু বলেছিলেন, ‘‘পারলে একটা গানই শোনাতাম। তাও পারছি না।’’ তার উত্তরে সংস্থার তরফে একজন মহিলা বললেন, ‘‘আমরা শুধু আপনাকে দেখতে এসেছি। যাতে এক সময় নাতি-নাতনিকে বলতে পারি ‘আমরা সুবীর সেনকে দেখেছি।’’