এডওয়ার্ড স্লোডেন যে মূল্যবান তথ্য জানিয়ে সচেতন করেছেন সমগ্র বিশ্বকে, তার ওপর ভিত্তি করেই এ দেশে প্রথম নাটক প্রযোজনা করল স্পন্দন ‘ব্রেকিং নিউজ’ (রচনা ও পরিচালনা – সমুদ্র গুহ)। যদিও নাটকের প্রথমে স্নোডেনের সম্পর্কে কিছু নেই। স্নোডেনের বিস্ফারিত বক্তব্য এল নাটকের দ্বিতীয় অর্ধে। এল এক নিটোল কাহিনির ভিত্তিতে। গল্পের শুরুতেই আইকন নামের এক যুবক একটি টেলিমিডিয়া হাউসে কর্মরত থেকে কর্মহীন হলেন। অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা, পৃথিবীর জঠরে কর্পদকশূন্য আইকন যখন ফিরে আসছিল চিৎপুর রেলইয়ার্ড ধরে, তখন পরিচয় হয় শ্রবণ চেট্টিয়ার নামের এক প্রবাসী ভারতীয়র। যিনি নাকি পালিয়ে এসেছেন ইস্তাম্বুল শহর থেকে।
চিৎপুরের আলো আঁধারির মাঝে শ্রবণের কথার গভীরে গিয়ে আইকন বুঝতে পারে যে, সে দাঁড়িয়ে আছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অধুনা একটি বিখ্যাত ইজরায়েলের অস্ত্রকোম্পানিতে কর্মরত অস্ত্রবিজ্ঞানের এক প্রতিভাবান প্রযুক্তিবিদের সামনে। শ্রবণকে এক অপরাধবোধ তাড়া করে ফেরে যখন সে দেখে তারই হাতে উদ্ভাবিত অস্ত্রসম্ভার কী ভাবে গড়ে তুলেছে মৃতদেহের পাহাড়। মধ্য এশিয়ার তহ্যাশালায় ধ্বস্ত মনুষ্যত্বের রক্ত লেখায় আঁকা উদ্বাস্তু শিবির ক্ষিপ্ত করে তোলে শ্রবণকে। এবং সে জেরুজালেমের একটি ওষুধের দোকানে ঢুকে একটি পেনড্রাইভে সযত্নে রাখা সর্বাধুনিক ক্ষেপনাস্ত্রর নকশা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ও গবেষণাগারে। কিন্তু সে জানত এসব কোম্পানির হাত অতি লম্বা। প্রত্যাঘাত আসবে দ্রুত। ইন্টারনেটে পাঠানো তথ্য সঠিক লক্ষ নাও অর্জন করতে পারে। তাই সে আরও অনেক তথ্য একটি মোবাইল ফোনে ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বহু দেশ। খুঁজছে সেই উপযুক্ত মানুষ যে তার উদ্দেশ্যকে ছড়িয়ে দেবে বিশ্ব জুড়ে। পরিণতিতে যুদ্ধ তৎপরতা পিছু হটবে।
কিন্তু বহু জায়গায় ঠকে গিয়ে সে আসে কলকাতায়। আইকনকে দূর হতে দেখে ধাওয়াও করে। কারণ অবিকল আইকনের মতো দেখতে একজনকে সে নাকি বহুদিন যাবৎ চেনে। ভুল ধরা পরে। কিন্তু শ্রবণ বুঝতে পারে সময় আর নেই। আর এ কাজ আইকন করলেও করতে পারে। কথপোকথনে চমৎকৃত আইকন ওই গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল হাতে নেওয়ায় নাটক এক বাঁকের মুখে হাজির হয়। গুপ্তঘাতকের চকিত আক্রমণে শ্রবণকে লাইনের পাশে রেখে সন্ত্রস্ত আইকন পালিয়ে যায়। কিন্তু সন্ত্রাস আরও জমাট বাঁধে তার নিজের খুপরি ঘরে ঢুকে। দেখে সেখানে এক অজানা আমেরিকান জর্জ দাঁড়িয়ে আছে তাকে নিয়ে আমেরিকায় যাবে বলে। কারণ, এই প্রথম আইকন জানতে পারে, তার এক যমজ ভাই ছিল। যাকে ওই অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়ে আমেরিকায় চলে যায় এক বাঙালি দম্পতি। যে পরবর্তীতে আমেরিকার গোয়ান্দা সংস্থা এনএসএ-র দক্ষ গোয়েন্দায় পরিণত হয়। কিন্তু হঠাৎ গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু যে কাজ সে চালাচ্ছিল জেরুজালেম ও হাইফা জুড়ে, এখন তার জায়গায় কাজ করতে হবে আইকনকে। আইকন বুঝতে পারে শ্রবণের কোথায় গণ্ডগোল হচ্ছিল। বিপুল অঙ্কের প্রতিশ্রুতিতে সে দেশ ছাড়ে।
আমেরিকায় আরেক ধুরন্ধর গোয়েন্দা প্রধান মরিস বিডেন তাকে জানায় যে মোবাইল ও ইন্টারনেট গোপন গোয়েন্দাগিরির কথা স্নোডেন মারফত বেফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারা মহাবিপাকে পড়েছেন। বিপাকের আরেক জায়গা হল যুদ্ধবিদ্ধস্ত মধ্যপ্রাচ্য। সেখানকার প্যালেস্তাইন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সমস্ত ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক এমন ভাবে বদলে ফেলেছেন যার কোনও হদিশ তারা পাচ্ছে না। এসব পরিকল্পনার মূলে রয়েছে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় পড়া এক তুখোড় মহিলা রাজনীতিবিদ, নাম ফারহা – আল-খাতিব। যার সঙ্গে ছদ্ম পরিচয়ে রিচার্ড খাতির তৈরি করতে পেরেছিল। কাহিনি যতই এগোয়, চমক বাড়ে ততই। একটুর জন্যও তথ্য ভারাক্রান্ত করে না নির্মেদ পরিচালনার জন্য। সমুদ্রর চমৎকার পরিচালনার সঙ্গে যথাযোগ্য সঙ্গত করেছেন আলো—উত্তীয় জানা, মঞ্চ পিকু ও আবহসঙ্গীতে কঙ্কন, দেবব্রত। কলকাতা – আমেরিকা – জেরুজালেমের তিনটি প্রেক্ষাপট চমৎকার দৃশ্যপট তৈরি করেছে।
মূল অভিনেতা আইকন (শুভাশিষ দত্ত) মানিয়েছে চমৎকার, সম্ভাবনা আছে কিন্তু এত ক্লান্ত কেন? শ্রবণের অভিনয়ে সমুদ্র ও মরিস বিডেনের ভূমিকায় তিতাস অনবদ্য। জর্জের ভূমিকায় সুমিত দাশগুপ্ত কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ফারহার চরিত্রে সুমিতা দত্ত সাবলিল। অন্যান্য চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন অনিমেষ রায়, জীবন রায়, সঞ্জয় দত্ত ও কৌতুক অভিনেতা পিনাকী মুখোপাধ্যায়।