আমজাদ আলি খান
এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন অগণন সংগীতপ্রেমী। ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স ২০১৬ সর্বতোভাবেই পূরণ করল তাঁদের প্রত্যাশা। চারটি দিনে কানায় কানায় পূর্ণ হল শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়। চারদিনের সারা রাত্রিব্যাপী এই অনুষ্ঠানটিকে একাই উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছেন যিনি, তিনি উস্তাদ আমজাদ আলি খান। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন রাত ও ভোরের সন্ধিক্ষণে তিনি শুরু করলেন রাগ পিলু। তারপর ভোরের মাহেন্দ্রক্ষণে উস্তাদজি যখন রাগ ভাটিয়ার বাজাতে শুরু করলেন, এক মিষ্টি সুরের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ল। উস্তাদজির সুন্দর আলাপ, জোড়ের পেলব স্পন্দন শ্রোতাদের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত আবেগে মিশে সৃষ্টি করেছিল এক অনির্বচনীয় আনন্দ। ভাটিয়ারের পর তিনি পঞ্চম সওয়ারিতে বাজালেন আনন্দ ভৈরব। উস্তাদজি জানালেন রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রভাবিত করেছেন তাঁকে, তারপর শুরু করলেন ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই...’। তারপর আবার শাস্ত্রীয় সংগীতে, প্রথমে গেয়ে শোনালেন তিলং রাগে তাঁর নিজের রচিত তারানা, তারপর সেটিই আবার বাজিয়ে শোনালেন। তবলায় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং পাখোয়াজে ফতে সিংহ গঙ্গানি যোগ্য সংগত করেছেন। উস্তাদ আমজাদ আলি খান প্রমাণ করে দিলেন তাঁর সৃষ্টি অতিক্রম করে গিয়েছে দেশ-কালের সীমারেখা।
শিবকুমার শর্মা বাজালেন মারু বেহাগ। তাঁর বাদনে বৈচিত্রের ছোঁয়া নেই, বলা যেতে পারে ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বট্ল। যদিও সন্তুরে যথার্থ আলাপ করা যায় না, তবুও তিনি তা বাজালেন এবং তাতে কোনও অভিনবত্ব ছিল না।
আমান আলি খান বাজাতে শুরু করলেন একটু স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে। তিনি যে ক্রমশ অনন্য হয়ে উঠছেন এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে হয়ে উঠছেন অপরিহার্য এক ব্যক্তিত্ব, তা প্রমাণিত হল তাঁর নিখঁুত পরিবেশনায়। আমান এখন অনেক পরিণত এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল, সেটা বোঝা গেল তাঁর প্রথম পরিবেশন রাগ ঝিঁঝোটি থেকে। কোনও শর্টকাটে না গিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলাপ করলেন, তারপর সাড়ে ন’মাত্রার গতে লয়ের তারতম্য বিস্তার করে মগ্ন রাখলেন শ্রোতাদের। খুব সুন্দর বাজিয়েছেন জোড় এবং ঝালা। বিশেষ করে তাঁর অত্যন্ত দ্রুতগতির ঝালা শুনে বিস্মিত হতে হল। কিরওয়ানি বাজিয়ে শেষ করলেন আমান। এই রাগটিকে তিনি অভিনব এবং বৈচিত্রপূর্ণ করে তুললেন ন’মাত্রা এবং তিন মাত্রার গতে বাজিয়ে। তাঁর সঙ্গে তবলায় নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই শিল্পীরা যেমন মাতিয়ে দিলেন অনুষ্ঠান, ঠিক তেমনই দর্শকদের হতাশ করলেন শিল্পী কৌশিকী চক্রবর্তী।
শ্রোতৃমণ্ডলীকে পরিতৃপ্ত করতে পারলেন না। স্টেজে উঠে তিনি অনেক কথা বললেন, যার বেশির ভাগটাই অপ্রয়োজনীয় এবং অনাবশ্যক। কথাবার্তার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের মাধুর্য কিছুটা ক্ষুণ্ণ করলেন বই কী। কৌশিকী মালকোষ গাইলেন। আওচার করলেন অত্যন্ত অল্প সময় এবং তা খুব-একটা চিত্তাকর্ষক হল না। দ্রত মধ্যলয়ে এবং দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে বন্দিশের মধ্যে একটা তাড়াহুড়ো এবং মনঃসংযোগের অভাব চোখে পড়ল। তবে তাঁর পরবর্তী পরিবেশনা যথাযথ।
শিল্পী মুকুল শিবপুত্রের গাওয়া রাগ কৌশিক একটু ম্রিয়মাণ লেগেছে। আওচারের পর বিলম্বিত দশ মাত্রা ধরলেন, তারপর তিন তাল। অবশ্য মন্দ লাগেনি মিশ্র পিলু ঠুংরি এবং দাদরা। তবে সব মিলিয়ে দর্শকরা কিছুটা একঘেয়েমির শিকার হলেন।
তেজেন্দ্রনারায়ণ সরোদে এবং কুশল দাস সেতারে যুগলবন্দি বাজালেন রাগ কৌশিকী কানাড়া। নিয়ম মেনে আলাপ, জোড় এবং ঝালা বাজালেও দু’জনের বাজনার মধ্যে কোঅর্ডিনেশন ঠিকমতো হয়নি। শেষে বাজালেন রাগ বসন্ত মুখারি। কিন্তু সেভাবে টেনে রাখতে পারলেন না শ্রোতৃমণ্ডলীকে।
এন রাজম, তাঁর মেয়ে এবং নাতনি সঙ্গীতা শঙ্কর, নন্দিনী ও রাগিণী শঙ্করকে নিয়ে ভায়োলিনের সমগ্র উপস্থাপনাটি সেভাবে কোনও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। গৎ বাজানোর সময় চারজন নিজেদের মধ্যে ঠিকমতো সমন্বয় সাধন করলেও খুব দীর্ঘ করে ফেলায় কিছুটা একঘেয়ে লেগেছে। মালকোষ বাজানোর মধ্যেও কোনও বৈচিত্রের ছোঁয়া লক্ষ করা যায়নি।
বাঁশিতে শিল্পী শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যম রাগ হেমবতী বাজালেন এবং আলাপ ও জোড়ে খুবই দীর্ঘ সময় নিলেন। এই সময় কিছুটা একঘেয়ে লাগছিল। এটি খুব মনোগ্রাহী না হলেও রাগ হংসধ্বনি ভাল লেগেছিল শ্রোতাদের। তবলায় শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃদঙ্গমে পত্রী সতীশকুমার যথাযথ সংগত করেছেন।
শিল্পী ভেঙ্কটেশ কুমারের উপস্থাপনা মন জয় করে নিল শ্রোতৃবৃন্দের। ললিত রাগ গাইতে শুরু করে দরাজ গলায় এবং সামান্য আওচার করেই যেভাবে তারসপ্তকে চলে গেলেন, তাতে রাগের সৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। তাঁর শক্তিশালী এবং একই সঙ্গে সুরেলা গলায় বিস্তার ও দ্রুত তান বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। অতি চমৎকার গাইলেন আহিরি ভৈরব এবং ভৈরবী। সব মিলিয়ে তাঁর পরিবেশন ভাল লেগেছে।
অনুপমা ভাগবৎ যখন সেতারে রাগ বাগেশ্রী বাজাতে শুরু করলেন তখন এক অদ্ভুত কাব্যময় স্নিগ্ধতায় পরিব্যাপ্ত হল প্রেক্ষাগৃহ। বাগেশ্রীর আলাপ খুব সুন্দর করেছেন। মন্দ্র ও মধ্য সপ্তকে রাগটির রূপ ঠিকঠাক মতো ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এর পর দুর্গা বাজিয়েছেন অনুপমা, দ্রুত একতালে। ইমদাদখানি ঘরানার এই শিল্পীর আলাপ, জোড়, ঝালা বেশ শ্রুতিমধুর, হাতের সূক্ষ্ম কাজ এবং মিড় বেশ ভাল।
(ডান দিক থেকে)অনুপমা ভাগবৎ, আমান আলি খান ও শওকত হুসেন খান
আগ্রা আত্রৌলি ঘরানার শিল্পী, উস্তাদ শওকত হুসেন খানের কণ্ঠ সুমধুর। হাতে গোনা যে কয়েকজন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী সঠিক আলাপ জানেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি অনন্য তাঁর বোল ও লয়কারীর দক্ষতায়। প্রথমে রাগ ঝিঁঝোটি গাইলেন, আলাপ করার পর বিলম্বিত, তারপর দ্রুত তিনতালে চলে গেলেন। তিনি তাঁর পিতা উস্তাদ শরাফত হুসেন খানের ধারা পুরোপুরি বজায় রেখেছেন। নিখুঁত বোলবাট এবং অসাধারণ লয়কারীর মাধ্যমে ছায়ানট রাগে ফৈয়াজ খানের কম্পোজিশন ‘পবন চলত সনন নিসদিন’। শওকত শেষ করেছেন মিশ্র খাম্বাজের উপর বন্দিশি ঠুংরি ‘উন হি কে মনায়ে বিনা না মানুগি,’ মন জয় করে নিল দর্শককুলের। তবলায় সুজিত সাহা অনবদ্য।
সন্দীপন সমাজপতি পুরিয়ায় বিলম্বিত খেয়াল গাইলেন, কিন্তু বৈচিত্রের অভাবে একঘেয়ে লাগল। দ্রুত খেয়ালটি খারাপ লাগল না। হামিরের তিনতাল খেয়ালটিও আগের মতো একই রকম লেগেছে।
শেষে রাগ বাহারের উপর পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর বিখ্যাত রাগপ্রধান ‘বনে বনে পাপিয়া বোলে’ গাইলেন।
প্রভাতী মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন ‘কা করু সজনী’ এবং ‘কোয়েলিয়া মৎ করে পুকার’, ‘জোছনা করেছে আড়ি’ ইত্যাদি জনপ্রিয় বাংলা ও ঠুংরি গান। তাঁর মালকোষ তেমন জমেনি।
পণ্ডিত যশরাজ মধুর গলায় শুরু করলেন রাগ নটভৈরব। নটভৈরবে বিলম্বিত ও সংক্ষিপ্ত খেয়াল গাওয়ার পর তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যে ললিত গেয়েছেন। একাধিক বিখ্যাত ভজন গেয়েছেন, যেমন, ‘গোবিন্দ গোকুল গোপাল’ ইত্যাদি। সব মিলিয়ে মোটামুটি লেগেছে তাঁর অনুষ্ঠান।
তবলায় যোগ্য সংগত করেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মিথিলেশ ঝা, সনাতন গোস্বামী, সুখবিন্দর সিংহ নামধারী প্রমুখ।
ছবিগুলি তুলেছেন রণজিৎ নন্দী